বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ (১৬ অক্টোবর) পালিত হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য—‘উন্নত খাদ্য এবং উন্নত ভবিষ্যতের জন্য হাতে হাত রেখে।’
উৎপাদন ও মজুতে বাংলাদেশ বড় সাফল্য দেখালেও, এখনো দেশের বহু মানুষ প্রতিদিনের খাবারের নিশ্চয়তা থেকে বঞ্চিত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৯ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন। যদিও গত কয়েক দশকে খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। চাল, মাছ, মাংস ও সবজিতে বাংলাদেশ এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিছু খাদ্যপণ্য রপ্তানির প্রস্তুতিও চলছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানায়, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদন তিন থেকে পাঁচ গুণ বেড়েছে। সরকারের দাবি, কৃষিতে বিনিয়োগ, প্রযুক্তির ব্যবহার ও নীতিগত সহায়তাই এই অগ্রগতির মূল কারণ।
তবে বাস্তবতা ভিন্ন। সরকার বলছে, দেশের খাদ্য মজুত ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কিন্তু বহু মানুষ এখনো তিনবেলা খাবার পাচ্ছে না। শহরের বস্তি থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত অসংখ্য পরিবার আছে, যাদের পক্ষে নিয়মিত খাওয়াটা সম্ভব নয়। প্রান্তিক, দরিদ্র, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর কাছে খাবার এখনো প্রতিদিনের লড়াই।
অনেক শিশু না খেয়ে স্কুলে যায়, গর্ভবতী মা পান না প্রয়োজনীয় পুষ্টি।
সরকারি তথ্যমতে, ২০২৫ সালের আগস্টে খাদ্যশস্য মজুতের পরিমাণ ছিল ২১ লাখ ৭৯ হাজার মেট্রিক টন—দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। অক্টোবরের শুরুর দিকে তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টনে।
তবু প্রশ্ন থেকেই যায়—এই খাদ্য মজুত কীভাবে বিতরণ হচ্ছে? তা কি সবার ঘরে পৌঁছাচ্ছে?
বাজারে কোথাও কোথাও খাদ্যপণ্য নষ্ট হচ্ছে বা অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে, অথচ দরিদ্র পরিবারগুলো পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য হারাচ্ছে। সরকার ইলিশের প্রজনন মৌসুমে তালিকাভুক্ত জেলেদের খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু এর বাইরেও বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ রয়েছেন, যারা এখনো সেই সহায়তার বাইরে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার রয়েছে। বাংলাদেশও সেই প্রতিশ্রুতির অংশীদার। কিন্তু বর্তমান দারিদ্র্যচিত্র বলছে, লক্ষ্য অর্জন এখনো কঠিন।
বিবিএসের দারিদ্র্য মানচিত্রে দেখা গেছে, দেশের ১৯ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে—যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপে এই হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
গ্রামে দারিদ্র্য কিছুটা কমে ২০ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে, যদিও ২০২২ সালে তা ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। শহরে উল্টো চিত্র—দারিদ্র্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশে, যা আগে ছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
বিভাগভিত্তিক হিসাবে সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্য বরিশালে—২৬ দশমিক ৬ শতাংশ। সবচেয়ে কম চট্টগ্রামে—১৫ দশমিক ২ শতাংশ। জেলা পর্যায়ে মাদারীপুর দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা, যেখানে দারিদ্র্যের হার ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ। সবচেয়ে কম দারিদ্র্য নোয়াখালীতে—মাত্র ৬ দশমিক ১ শতাংশ।
উপজেলা পর্যায়ে মাদারীপুরের ডাসার সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা, সেখানে দারিদ্র্যের হার ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ। বিপরীতে ঢাকার পল্টনে দারিদ্র্য মাত্র ১ শতাংশ।
রাজধানীতেও বৈষম্য স্পষ্ট। কামরাঙ্গীরচরে দারিদ্র্য হার ১৯ দশমিক ১ শতাংশ, ভাষানটেকে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, মিরপুরে ১২ দশমিক ২ শতাংশ ও বনানীতে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। বিপরীতে নিউমার্কেটে এই হার ১ দশমিক ৭ শতাংশ, ধানমন্ডিতে ১ দশমিক ৫, মতিঝিলে ৩ দশমিক ৬ এবং গুলশানে ৩ দশমিক ২ শতাংশ।
বিশ্ব খাদ্য দিবসে তাই প্রশ্ন থেকে যায়—উৎপাদনে সাফল্য সত্ত্বেও, দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছাতে এখনো কেন এত বৈষম্য?

