চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড) এখন গভীর শিল্প ও মানবিক সংকটের মুখে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা শ্রমিক অসন্তোষ, সংঘর্ষ ও সাম্প্রতিক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুরো অঞ্চলটি যেন অস্থিরতার চক্রে বন্দি। এই ধারাবাহিক অস্থিরতায় বিনিয়োগের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পাশাপাশি হাজার হাজার শ্রমিকের জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
শুধু গত ১০ মাসেই সিইপিজেডসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে ১৬টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, ফলে বেকার হয়েছেন ৫৯ হাজার ৩৭৩ জন শ্রমিক।
সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের সাতটি কারখানা বন্ধের ঘটনায়। সংঘর্ষের জেরে গত ১৭ অক্টোবর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হওয়া এই কারখানাগুলোর প্রায় ৩৫ হাজার শ্রমিক এখন বেকার জীবনের মুখে।
এর আগে ১৬ অক্টোবর সিইপিজেডের অ্যাডামস ক্যাপস ও জিহং মেডিক্যাল প্রোডাক্ট ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়। টানা ১৭ ঘণ্টা আগুন জ্বলার পরও হাজারো শ্রমিকের চোখেমুখে ছিল অনিশ্চয়তার ছায়া।
সিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আব্দুস সোবহান জানিয়েছেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা সীমিত ছিল। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে, ভবনগুলোর সেটব্যাক না থাকায় আগুন নেভাতে দেরি হয়। আগুনের রেশ কাটার আগেই প্যাসিফিক জিনসের কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে হাজারো শ্রমিকের পরিবারের ওপর নেমে আসে অনিশ্চয়তা।
চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, “কারখানা বন্ধের চিঠি আমরা পেয়েছি। শ্রমিকদের মধ্যে কিছু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব রয়েছে। বাইরে থেকে কেউ ইন্ধন দিচ্ছে কি না, তা তদন্ত চলছে।” তিনি জানান, যত দিন কারখানা বন্ধ থাকবে, শ্রমিকরা তত দিন কোনো বেতন পাবেন না।
শ্রমিক কবির হোসেন বলেন, “একটি পক্ষ মালিকপক্ষকে কারখানা বন্ধে বাধ্য করেছে। এতে ৩৫ হাজার শ্রমিকের আয় বন্ধ। ব্যাংকে থাকা সামান্য টাকাও তুলতে পারছি না।” প্যাসিফিক অ্যাকসেসরিজের শ্রমিক মো. সালাউদ্দিন বলেন, “আমি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। এখন চাকরি হারিয়ে পরিবার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে।”
বিজিএমইএ চট্টগ্রাম অফিসের তথ্যমতে, ২০০৫ সালে চট্টগ্রামে নিবন্ধিত কারখানা ছিল ৬৯৯টি, এর মধ্যে সচল ছিল ৬১০টি। বর্তমানে সচল কারখানার সংখ্যা নেমে এসেছে ৩৪১টিতে। অর্থাৎ এই সময়ে ২৬৯টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যেখানে অন্তত অর্ধলক্ষ শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন।
চলতি বছরেই ১৬টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, ফলে ৫৯ হাজার ৩৭৩ শ্রমিক বেকার হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু প্যাসিফিক জিনস গ্রুপেই চাকরি হারিয়েছেন ৩৫ হাজার শ্রমিক। এছাড়া গত ২৫ সেপ্টেম্বর নাসা গ্রুপের দুটি পোশাক কারখানা বন্ধের ফলে বেকার হয়েছেন আরও আড়াই হাজার শ্রমিক।
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, “শ্রমিক অসন্তোষ এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এই অস্থিরতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে অনেক মালিকই ফ্যাক্টরি চালাতে ভয় পাবেন।” তিনি শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিয়ে গোয়েন্দা নজরদারি জোরদারের আহ্বান জানান।
চট্টগ্রাম ইপিজেড গঠিত হয় চার দশক আগে মাত্র ৬২৪ শ্রমিক নিয়ে। বর্তমানে এই অঞ্চলে ১৪৪টি কারখানায় কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে। ১৩টি দেশের বিনিয়োগ ও বার্ষিক এক বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় থাকা এই অঞ্চলের সাম্প্রতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে এবং শ্রমিকদের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার।