দেশজুড়ে সরকারি চাকরিজীবীদের মুখে এখন একটাই আলোচ্য বিষয়—নতুন পে স্কেল। প্রায় এক দশক পর বেতন কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আসতে চলেছে। সরকারের লক্ষ্য, ২০২৬ সালের মার্চের আগেই ঘোষণা দেওয়া। প্রাথমিক সূত্র বলছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ হতে পারে।
এই খবরে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন দেশের প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ সরকারি কর্মচারী। তবে একই সঙ্গে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি খাতে কর্মরত কয়েক কোটি মানুষের মনে। কারণ, সরকারি বেতন বাড়লেই সাধারণত বাড়ে বাড়িভাড়া, স্কুলের ফি, চিকিৎসা খরচ, এমনকি বাজারের পণ্যের দামও।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কথা বলে জানা গেছে, বহু মানুষই এখন চিন্তিত—এই বেতন বৃদ্ধি যেন না হয়ে ওঠে নতুন দুঃস্বপ্নের সূচনা।
এক দশক পর নবম পে কমিশনের সুপারিশ
২০১৫ সালে অষ্টম পে স্কেল ঘোষণার পর এবার গঠিত হয়েছে নবম পে কমিশন ২০২৫। এই কমিশনের সুপারিশেই চূড়ান্ত হবে নতুন বেতন কাঠামো। সরকারি কর্মকর্তাদের আশা—শুধু বেতন নয়, এবার গ্রেডভিত্তিক বৈষম্যও কমবে।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, নতুন কাঠামোয় মূল বেতন দ্বিগুণ করার প্রস্তাব উঠেছে। এতে প্রথম গ্রেডের সর্বোচ্চ বেতন দাঁড়াতে পারে ১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা, আর ২০তম গ্রেডের সর্বনিম্ন বেতন হতে পারে ১৬ হাজার ৫০০ টাকা। তবে যদি গ্রেড সংখ্যা ২০ থেকে কমানো হয়, তাহলে নিম্ন গ্রেডের বেতন আরও বাড়তে পারে।
বর্তমানে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত প্রায় ১০:১। কমিশন নতুন স্কেলে এই অনুপাত ৮:১ থেকে ১০:১-এর মধ্যে রাখার বিষয়টি বিবেচনা করছে।
বেতন বাড়লে বাজারও গরম হয়
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন—সরকারি বেতন বৃদ্ধি মানেই খরচের ধাক্কা। রাজধানীতে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইসমাইল হোসেনের ভাষায়,
“সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়লেই আমাদের জীবন আরও কঠিন হয়। প্রথমেই বাড়ে বাড়িভাড়া, স্কুলের ফি, তারপর বাজার। একে তো আয় বাড়ে না, উল্টো টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়ে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনই দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭.৬৪% এবং সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৮.৩৬%। সরকারি বেতন বাড়লে তা আরও বাড়বে।
অর্থনীতির চিত্র আশাব্যঞ্জক নয়
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, গত অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৬৯%, যা পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বিশ্বব্যাংকও তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি নামতে পারে ৪.৯%-এ।
অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট ২০২৫ জানাচ্ছে—অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে অতি দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে পারে।
বর্তমানে দেশে প্রায় ২৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, আর ৪ কোটি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে ভুগছে।
আগের স্কেলগুলোতে যা হয়েছিল
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আটটি পে স্কেল কার্যকর হয়েছে। ইতিহাস বলছে, গড়ে প্রতি ৫ থেকে ৬ বছর অন্তর সরকারি চাকরিজীবীরা নতুন স্কেল পান।
-
১৯৮৫: সর্বোচ্চ বেতন দ্বিগুণ করে ৬ হাজার, সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা
-
১৯৯১: সর্বোচ্চ ১০ হাজার, সর্বনিম্ন ৯০০ টাকা
-
২০০৫: সর্বোচ্চ ২৩ হাজার, সর্বনিম্ন ২,৪০০ টাকা
-
২০১৫: সর্বোচ্চ ৭৮ হাজার, সর্বনিম্ন ৮,২৫০ টাকা
এবার যদি দ্বিগুণ হয়, তাহলে এটি হবে দেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় বৃদ্ধি।
দাবি: সর্বনিম্ন ৩২ হাজার, সর্বোচ্চ ১ লাখ ২৮ হাজার
সচিবালয়ের ১১–২০তম গ্রেড সরকারি চাকরিজীবী ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন,
“২০১৫ সালের পর অন্তত দুটি কমিশন হওয়া উচিত ছিল। এবার আমরা চাই ১৫০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি, যাতে বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে। সর্বনিম্ন বেতন কমপক্ষে ৩২ হাজার, আর সর্বোচ্চ ১ লাখ ২৮ হাজার হওয়া দরকার।”
তবে অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, সরকারের পক্ষে সব চাহিদা পূরণ করা সহজ হবে না। তিনি বলেন,
“পে কমিশনের কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। বাস্তবায়ন সম্ভবত ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে শুরু হবে। তবে অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও মূল্যস্ফীতির প্রভাব বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।”
সরকারি কর্মচারীদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে সুখবর। কিন্তু বেসরকারি খাতের মানুষ, দিনমজুর, দোকান কর্মচারী কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এখন চিন্তায়।
কারণ, সরকারি বেতন বাড়লেই বাজারে “ঢেউ” লাগে—যা ছুঁয়ে যায় সবাইকে। ফলে নতুন পে স্কেল ঘোষণার আনন্দের মাঝেও প্রশ্নটা থেকেই যায়—এই সুখবর সবার জন্য সুখকর হবে তো?