বিশ্বজুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সরকারি পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ধরন পরিবর্তন করছে। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এখনও প্রায় ৬০ শতাংশ তথ্য কাগজভিত্তিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ করছে।
বিবিএসের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, এই ম্যানুয়াল পদ্ধতির ওপর নির্ভরতা সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন তোলে। শুধু তাই নয়, কাগজভিত্তিক তথ্য সংগ্রহের ফলে কৃষি উৎপাদন, বেকারত্ব, খাদ্য নিরাপত্তা এবং নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব তৈরি হয়। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগও থাকে।
আগের আওয়ামী সরকারের পতনের পর প্রকাশিত ‘হোয়াইট পেপার অন দ্য স্টেট অব দ্য বাংলাদেশ ইকোনমি’ প্রতিবেদনে দেশের তথ্যব্যবস্থাকে ‘অত্যন্ত অস্পষ্ট’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। প্রতিবেদনে পরিসংখ্যান সংস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান জানানো হয়।
এ আহ্বানকে সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকার বিবিএসকে আধুনিকায়নের জন্য বেশ কয়েকটি সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে। বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, ‘যদি এগুলো সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তা ফলপ্রসূ হবে।’
বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবসের প্রেক্ষাপটে তিনি জানান, সংস্থার ধীরগতির ডিজিটাল রূপান্তরের মূল কারণ হলো বাজেট সীমাবদ্ধতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ধীরগতি।
তিনি আরও বলেন, কিছু জরিপে বিবিএস ইতিমধ্যে কম্পিউটার-অ্যাসিস্টড পারসোনাল ইন্টারভিউ (সিএপিআই) পদ্ধতি চালু করেছে, যা ট্যাবের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। তবে এখনও এটি সারাদেশে সম্প্রসারিত হয়নি। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সব প্রধান জরিপকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আনা হবে।
বিবিএস ‘বিগ ডেটা প্ল্যাটফর্ম’ তৈরির পরিকল্পনাও করছে। এর মাধ্যমে মাঠ জরিপের ওপর নির্ভরতা কমানো হবে এবং অন্যান্য সংস্থা থেকে পাওয়া প্রশাসনিক তথ্য আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যাবে। তবে মহাপরিচালক স্বীকার করেছেন, বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার মধ্যে ডেটা-শেয়ারিং ও আন্তঃসংযোগ এখনও পর্যাপ্ত নয়।
পরিসংখ্যান সংস্থার স্বাধীনতা ও তথ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করার জন্য সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। তিনি জানান, কমিটি ইতিমধ্যেই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যাতে বিবিএসকে আরও স্বায়ত্তশাসিত ও গতিশীল সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে ছয়টি পরিসংখ্যান শাখার জন্য বহু-পক্ষীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা স্বচ্ছতা বাড়াতে সহায়ক হবে। নতুন পদ্ধতি চালু হলে জরিপ ফলাফলের জন্য আর মন্ত্রীর অনুমোদন লাগবে না।
বিবিএসের সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবুল ওয়াজেদ বলেন, কৃষি খাতের তথ্যসহ সব গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান সময়মতো প্রকাশ করা উচিত। তিনি বলেন, ‘যদি হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভের মতো জটিল জরিপের তথ্য তিন মাসের মধ্যে প্রকাশ করা যায়, তবে কৃষি তথ্যের ক্ষেত্রেও একই সময়সীমা মানা উচিত।’
তবে বিবিএস বর্তমানে জনবল ঘাটতির সমস্যায় ভুগছে। সংস্থার মোট পদগুলোর মাত্র অর্ধেকই পূর্ণ। এই সংকট পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাকে দুর্বল করছে এবং তথ্যের অখণ্ডতা নষ্ট করছে। ওয়াজেদ মন্তব্য করেন, ‘বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যানই সুশাসনের মেরুদণ্ড। সময়মতো নির্ভরযোগ্য তথ্য ছাড়া নীতিগত ব্যর্থতা ঠেকানো কঠিন।’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, জাতীয় তথ্যকে সত্যিকারের নির্ভরযোগ্য করতে হলে শুধু ক্ষুদ্র পরিবর্তন নয়, কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘বিবিএসকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো আইনি ও কার্যকর স্বায়ত্তশাসন দেওয়া প্রয়োজন। এতে সংস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে রক্ষা করা যাবে এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।’
রায়হান আরও বলেন, স্বায়ত্তশাসনই যথেষ্ট নয়, পরিসংখ্যান ব্যুরোকে নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহের জন্য প্রয়োজন যথাযথ সরঞ্জাম, দক্ষতা ও সম্পদ। তিনি একটি একীভূত জাতীয় তথ্য কৌশল (ন্যাশনাল ডেটা স্ট্রাটেজি) গঠনেরও আহ্বান জানান, যা রিয়েল-টাইম ডিজিটাল সিস্টেমের মাধ্যমে বিবিএসকে সব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এতে তথ্যের পুনরাবৃত্তি এড়ানো যাবে, সামঞ্জস্য নিশ্চিত হবে এবং সরকারি সংস্থাগুলোকে একই ধরনের তথ্য সরবরাহের সক্ষমতা তৈরি হবে।
এছাড়া তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি উচ্চপর্যায়ের ডেটা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেন, যা তথ্যের মান নির্ধারণ করবে এবং অসামঞ্জস্য সমাধান করবে। তার ভাষ্য, ‘রিয়েল-টাইম তথ্যপ্রবাহ শুধু সফটওয়্যারের বিষয় নয়, এটি নেতৃত্ব ও জবাবদিহিতার বিষয়ও।’
সংক্ষেপে, বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এখন সময়ের দাবি। ডিজিটাল রূপান্তর, স্বায়ত্তশাসন, দক্ষ জনবল ও কার্যকর নীতিমালা ছাড়া নির্ভরযোগ্য তথ্য ও নীতি গঠন কার্যকরভাবে সম্ভব নয়।