রাজধানীর ব্যস্ততম সিগন্যালগুলোর একটি বিজয় সরণি। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সেখানে থামল একটি সাদা প্রাইভেটকার। মিরপুর থেকে আসা গাড়িটির গন্তব্য ফার্মগেট হয়ে বাংলামোটর। মাত্র দুই মিনিটেই বিজয় সরণির সিগন্যাল পেরিয়ে গাড়িটি পৌঁছে গেল ফার্মগেট মোড়ে। কারওয়ান বাজার সিগন্যালে গিয়ে চালকের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের।
চালক বলেন, তিনি পাঁচ বছর ধরে গাড়িটি চালান। প্রতিদিন মিরপুর শেওড়াপাড়া থেকে ম্যাডামকে নিয়ে বাংলামোটরের অফিসে যান। আগে বিজয় সরণির সিগন্যালে ১৫–২০ মিনিট আটকে থাকতে হতো। এখন নতুন সিগন্যাল বাতিতে টাইমার যুক্ত হওয়ায় দুই থেকে তিন মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হয় না। তিনি বলেন, “ডিসপ্লেতে সময় দেখা যায়। সময় শেষ হলেই সবুজ বাতি জ্বলে ওঠে, আর আমরা চলতে পারি।”
বুয়েটের সহায়তায় নতুন ট্রাফিক
ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণে এবার নতুন উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কারিগরি সহায়তায় হাইকোর্ট মোড় থেকে শাহবাগ, বিজয় সরণি হয়ে বিমানবন্দর পর্যন্ত মোট ২২টি মোড়ে আধুনিক সিগন্যাল বাতি বসানো হচ্ছে। এর মধ্যে সাতটি মোড়ে ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে। ফলে এই এলাকাগুলোর দীর্ঘদিনের যানজটের চিত্রে পরিবর্তন এসেছে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওতায় বসানো নতুন ট্রাফিক বাতিগুলো তৈরি হয়েছে দেশীয় প্রযুক্তিতে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। বুয়েট প্রযুক্তিগত পরামর্শক ও নির্মাতা হিসেবে কাজ করছে। এর মধ্যে উত্তর সিটিতে ১৪টি এবং দক্ষিণ সিটিতে আটটি মোড়ে এই সিগন্যাল বসানো হবে।
বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে দুই সিটি করপোরেশন, নেতৃত্ব দিচ্ছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ), আর শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে ট্রাফিক পুলিশ।
ইতোমধ্যে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় গেটসংলগ্ন ইউটার্ন ও জাহাঙ্গীর গেট মোড়ে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল চালু হয়েছে। এই সিগন্যালগুলো শুধু যানবাহন নিয়ন্ত্রণই নয়, পথচারী পারাপারের সময়ও নির্ধারণ করছে। দুই থেকে তিন মিনিট পরপর সব দিকের যানবাহন বন্ধ থাকে, যাতে নিরাপদে মানুষ রাস্তা পার হতে পারে।
সময়ের ভিত্তিতে যান চলাচল
বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা গত কয়েক মাস রাজধানীর সড়কে যানচলাচলের পরিমাণ নিয়ে জরিপ করেছেন। সেই তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি সিগন্যাল পয়েন্টে পিক ও অফ-পিক সময়ে আলাদা সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে ‘সাইকেল’। প্রতিটি সাইকেল দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে সম্পন্ন হয়।
উদাহরণ হিসেবে, কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁও মোড়ে চারটি সড়কের জন্য তিন মিনিট সময় বরাদ্দ। সবুজ বাতি জ্বলে এক দিকের যানবাহন চলে, তারপর হলুদ ও লাল বাতি জ্বলে সেটি থামে, আর অন্যদিকের যানবাহন শুরু করে। ফলে আগের মতো দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না।
চালকদের অভিজ্ঞতা: সময় বাঁচছে, ভোগান্তি কমছে
দেওয়ান পরিবহনের চালক বারেক মিয়া বলেন, “আগে বিজয় সরণিতে ২০ মিনিট বসে থাকতে হতো, এখন লাগে দুই–তিন মিনিট। কারওয়ান বাজারেও এখন আর আগের মতো জট থাকে না।”
তিনি আরও জানান, “এখন সিগন্যালে কাউন্টডাউন চলে। সময় শেষ হলেই সবুজ বাতি জ্বলে, একদিক বন্ধ হয়ে অন্যদিক খোলে। এতে সবার সুবিধা হচ্ছে।”
সিএনজি চালক বাচ্চু মোল্লাও বলেন, “আগে মহাখালী থেকে আসতে বিজয় সরণিতে সারি লেগে যেত জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত। ট্রাফিক পুলিশ একে একে ছাড়ত, সময় লাগত অনেক। এখন টাইমার চলছে, তিন মিনিটের মধ্যে সিগন্যাল বদলায়। এতে যানজট অনেক কমে গেছে।”
কারওয়ান বাজারে দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক কর্মকর্তা শফিউল আলম বলেন, “নতুন সিগন্যাল চালুর পর যানজট অনেক কমেছে। পুলিশ এখনো চালকদের সহায়তা করছে, যেন সবাই নিয়ম বুঝে চলতে পারে। আগে যেখানে অপেক্ষা ছিল ১৫–২০ মিনিট, এখন তা কমে এসেছে তিন মিনিটে।”
তিনি আশা প্রকাশ করেন, “চালকরা যখন এই পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন, তখন আরও সুফল মিলবে।”
ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আক্তার বলেন, “সিগন্যাল ব্যবস্থায় সফল হতে হলে চালক ও পথচারী উভয়কেই সচেতন হতে হবে। সাতটি স্থানে পরীক্ষা চলছে, বাকি ১৫টি মোড়ে চালু হলে ঢাকার সড়কব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসবে।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার রাজীব খাদেম জানান, “বুয়েট তৈরি করেছে এসব ট্রাফিক সিগন্যাল ও যন্ত্র। আমরা স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করছি। ট্রাফিক পুলিশ তত্ত্বাবধান করছে। ঢাকায় শৃঙ্খলাপূর্ণ সড়ক গড়ে তুলতে এটি বড় পদক্ষেপ।”