২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৬৭ হাজার ৮৯০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৭২৬ জন নিহত ও ১ লাখ ৬৫ হাজার ২১ জন আহত হয়েছে।
মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০২৫ উপলক্ষে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই তথ্য তুলে ধরেন।
মোজাম্মেল হক বলেন, স্বাধীনতার আগে দেশের মানুষের যাতায়াতের ৮০ শতাংশ নৌ ও রেলপথে এবং ২০ শতাংশ সড়কে হতো, তাই দুর্ঘটনা সীমিত ছিল। স্বাধীনতার পর দাতা সংস্থার পরামর্শে একের পর এক নতুন সড়ক নির্মাণ করা হয়। ফলে ৮০ শতাংশ মানুষের যাতায়াত সড়কে চলে আসায় দুর্ঘটনাও ৮০ শতাংশ বেড়ে যায়। ‘সড়কে এই গণহত্যার’ দায় সরকারের দুর্নীতি ও ভুলনীতিতেই আছে।
দুর্ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে—সড়ক পরিবহন খাতে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি, মালিক-শ্রমিকদের দৌরাত্ম্য, কিছু দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তার চাঁদাবাজি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, লাইসেন্সবিহীন বা অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক, সড়কের ত্রুটি, চালকের মাদক গ্রহণ, বেপরোয়া গতি, অযোগ্য চালকের হাতে লাইসেন্স প্রদান—এসব কারণে সড়কের বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা বেড়েছে। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমও অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ।
মোজাম্মেল হক বলেন, স্বাধীনতার পর দেশ নানা খাতে অগ্রসর হলেও নৌ ও রেলপথ অবহেলিত থেকে গেছে। বরং একের পর এক সড়ক সম্প্রসারণে সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। পথচারী অবকাঠামোর অভাব ও উন্নত গণপরিবহনের সংকটে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।
তিনি আরো বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা, নসিমন-করিমন ও লেগুনার মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক যানবাহন বাস নেটওয়ার্ক ভেঙে দিয়েছে। ফলে যানজট ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী অভিযোগ করেছেন, এক যুগেরও বেশি সময় সড়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকেও ওবায়দুল কাদের পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। পরিকল্পনা ও কৌশলের অভাবে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েছে। সরকার পরিবর্তনের পরও সড়ক মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগের নীতি না বদলানোয় পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। তিনি বলছেন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ছাড়া দুর্ঘটনা ও যানজট কমানো সম্ভব নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিবন্ধনের উদ্যোগও বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে তিনি মনে করেন। মোজাম্মেল হক বলেন, এতে এক বছরের মধ্যেই ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর অচল হয়ে পড়বে।
সংগঠনটি আগামীকাল নিরাপদ সড়ক দিবসকে সামনে রেখে দেশের সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এবং যাতায়াতের ভোগান্তি লাঘব করতে ১২ দফা সুপারিশ করেছে:
১. হারানো নৌ ও রেলপথকে সড়কের সঙ্গে সমন্বয় করে সমন্বিত যাতায়াত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।
২. চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি বন্ধে পরিবহন খাত আপাদমস্তক সংস্কার।
৩. ঢাকা-চট্টগ্রামসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সরকারি উদ্যোগে ম্যাস ট্রানজিট ব্যবস্থা (পাতাল মেট্রোরেল)।
৪. প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সরকারি উদ্যোগে ডিজিটাল লেনদেনের ভিত্তিতে দু’টি বাস র্যাপিড ট্রানজিট লেন চালু।
৫. জেলা থেকে উপজেলায় মানসম্পন্ন বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।
৬. মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত ও সিএনজি অটোরিকশা আমদানি ও বিপণন বন্ধ।
৭. উন্নত কারিকুলামের মাধ্যমে চালক প্রশিক্ষণ রাষ্ট্রের খরচে প্রদান।
৮. উন্নত দেশের মতো ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম ডিজিটাল করা এবং ট্রাফিক ট্রেনিং একাডেমি গড়ে তোলা।
৯. সড়ক দুর্ঘটনার মামলা সরকারি উদ্যোগে আমলে নেওয়া এবং ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা।
১০. পরিবহন খাতে যাত্রী ও ভুক্তভোগীর মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
১১. আইনের সুশাসন নিশ্চিত করা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
১২. সাইক্লিস্ট ও পথচারীদের জন্য পৃথক লেন এবং নিরাপদ ফুটপাতের ব্যবস্থা।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি শরীফ রফিকুজ্জামান, বারভিডার সভাপতি আবদুল হক এবং ড্রাইভার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান বাদল আহমেদ।