সড়কে প্রাণঘাতী ঝুঁকিতে ঢাকার বাসযাত্রা—
রাজধানীসহ সারাদেশে গণপরিবহন ব্যবস্থার নাজুক ও ভঙ্গুর অবস্থা যাত্রীদের জন্য নিত্যদিনের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাসের দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না, জানালায় ফাটল, ব্রেক অচল, হেডলাইট কাজ করে না— তবু এসব যানবাহন “ফিটনেস সার্টিফিকেট” নিয়ে চলাচল করছে। বাস্তবে এই ‘ফিটনেস’ কেবল কাগজে সীমাবদ্ধ; প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাসে ওঠেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যা কেবল প্রশাসনিক দুর্বলতা নয়; এটি ঘুষ, প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার জটিলতার ফলাফল।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে চলাচলকারী বাণিজ্যিক বাসের প্রায় ৪২ শতাংশের ফিটনেস নবায়ন করা নেই। সারাদেশে জুন পর্যন্ত নিবন্ধিত বাসের সংখ্যা ৫৬,৭৩৩টি। এর মধ্যে ২৩,৬৬৫টি বাস, ২৮,৫৬১টি মিনিবাসের মধ্যে ১১,৯০৫টি এবং ১৭,৩৭৪টি হিউম্যান হলারের মধ্যে ১৪,৫১০টির ফিটনেস নবায়ন করা হয়নি। প্রধান শহর ঢাকায় প্রায় ৪৩,৬৭৬টি বাস চলাচল করছে, যার মধ্যে ৮৫ শতাংশই ফিটনেসবিহীন।
আনফিট বাসের রমরমা ব্যবসা-
রাজধানীর ব্যস্ততম রুটগুলোতে সরেজমিনে দেখা যায়, ১০টির মধ্যে সাত থেকে আটটি বাস দৃশ্যমানভাবে ফিটনেসবিহীন। এসব বাসের দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না, জানালায় ফাটল, বডিতে মরিচা, টায়ারের বাতাস অনিয়ন্ত্রিত। হেডলাইট, ইন্ডিকেটর লাইট ভাঙা, ব্রেকিং সিস্টেম ঝুঁকিপূর্ণ। এমন বাসে যাত্রীরা বাধ্য হয়ে ওঠেন।
আদনান সাজীম, যিনি আবুল হোটেল থেকে বসুন্ধরা বাসস্টপ পর্যন্ত নিয়মিত যাতায়াত করেন, বলেন, “সর্বশেষ কখন একটি বাস দেখে মন ভালো হয়েছিল, মনে নেই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাসগুলো দেখলেই ভয় লাগে। কোনো বাস একদিকে কাত, রঙ উঠে গেছে, গ্লাস ভাঙা। চালক মানছেন না কোনো নিয়ম।”
তিনি আরো বলেন, “বাসের ভেতরের অবস্থা আরও খারাপ। সিটগুলো ছোট, সিট কভার নোংরা, ফ্যান নষ্ট। গরমে যাত্রীরা ঘামে ভিজে যান। প্রতিদিন এমন বাসে উঠতে ভয় লাগে। এটা শুধু শারীরিক ঝুঁকি নয়, মানসিক চাপও বড়। তবুও এই ভাঙাচোরা বাসই ভরসা।”
সুমাইয়া রহমান, কলাবাগান থেকে উত্তরা রুটের নিয়মিত যাত্রী, জানান, “অনেক বাসে হঠাৎ ব্রেক ধরলে মনে হয় গাড়ি উল্টে যাবে। জানালা বন্ধ হয় না, ধুলো ঢুকে যায়। সিট ছেঁড়া-ময়লা। তারপরও এসব বাসে যাত্রীদের ওঠা ছাড়া বিকল্প নেই।”

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা-
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, “বাসের ফিটনেস ইস্যু শুধুই প্রশাসনিক নয়; এটি ঘুষ, প্রভাব ও দুর্বল নীতিনির্ধারণের জটিল চক্রে আটকে। মালিক ও সমিতির নেতাদের প্রভাব এত গভীর যে সরকারও তাদের সামনে অসহায়। সরকারিকরূপে নীতিনির্ধারকরা মালিকবান্ধব নীতি গ্রহণ করছেন, জনবান্ধব নয়।”
বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশে ৩৮৬টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ২,৬১৮টি গাড়ির বিরুদ্ধে, ১৩ জন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত, ৩৬৪টি গাড়ি ডাম্পিং করা হয়েছে এবং মোট জরিমানা আদায় হয়েছে ৬৫ লাখ ২১ হাজার ১০০ টাকা।
তুলনামূলকভাবে, বিশ্বের উন্নত দেশে বাণিজ্যিক বাসের ফিটনেস পরীক্ষা কঠোর ও নিয়মিত। যেমন, জার্মানিতে বছরে একবার বাধ্যতামূলক পরীক্ষা, ব্যর্থ হলে মেরামতের নির্দেশ, তা না হলে লাইসেন্স সাসপেন্ড। ফ্রান্সে বছরে একবার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক, ব্যর্থ হলে ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মেরামত করতে হবে। জাপানে প্রতি এক থেকে দুই বছর অন্তর ফিটনেস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক।
বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে ঘুষের বিনিময়ে আনফিট যানবাহনও ‘ফিট’ হয়ে যায়।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “ফিটনেস প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হিসেবে বিআরটিএ’র নিজের টেকনিক্যাল সক্ষমতা দুর্বল। অনেক ক্ষেত্রেই চোখে দেখে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। ঘুষের বিনিময়ে আনফিট বাসও ‘ফিট’ ঘোষণা করা হয়। তাই এখন প্রশ্ন—যানবাহনের ফিটনেস দেখার আগে বিআরটিএ’র নিজের ফিটনেস আছে কি না।”
ঘুষের জট এবং বাস-মালিকদের চাপ-
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, একটি বাণিজ্যিক বাসের রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ফিটনেস সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন, ইন্স্যুরেন্স সার্টিফিকেট এবং রুট পারমিট থাকা বাধ্যতামূলক। এর মধ্যে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট একবার নেওয়া হলে আজীবনের জন্য বৈধ, কিন্তু বাকিগুলো প্রতি বছর নবায়ন করতে হয়।
বাস-মালিকদের অভিযোগ, “নির্ধারিত ফি দেওয়ার পরও ঘুষ ছাড়া ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না। ঘুষ ন্যূনতম ৫,০০০ থেকে সর্বোচ্চ ২০,০০০ টাকা।”
এক বাস-মালিক বলেন, “গাড়ি ঠিক থাকলেও টাকা না দিলে ইন্সপেক্টর কোনো না কোনো ত্রুটি ধরবে। কিছু সমস্যা থাকলে ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। টাকা দিতে হয় দালালের হাতে। না দিলে গাড়ি ফেল করা হয়।”
অপর বাস-মালিক জানান, সামনের গ্লাসে সামান্য ফাটাও ধরলে ফেল করা হয়, আবার নতুন গ্লাস লাগাতে খরচ হয় ৪০,০০০ টাকা। রেজিস্ট্রেশনের জন্যও কখনও ৩০,০০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এইসব অনিয়মের ফলে বাস্তবে ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলে।

যাত্রীদের ভয়ানক বাস্তবতা-
বাসের ভেতরের পরিবেশ অত্যন্ত অস্বস্তিকর। সিটগুলো ভাঙাচোরা ও নোংরা, মাথার অংশে ময়লা জমে থাকে। ফ্যান নষ্ট, লাইট ভাঙা। বসার জায়গা এত সংকুচিত যে সামনের সিটের সঙ্গে হাঁটু লেগে যায়।
আদনান বাবু আদর, যিনি টেকনিক্যাল মোড় থেকে ফার্মগেট যাওয়ার সময় বাসে ওঠেন, বলেন, “হাঁটুর কাছে টিন বাঁকা, রক্ত বের হচ্ছে। কন্ডাক্টর শুধু ‘সরি’ বলে চলে গেল। পাঁচ কিলোমিটার পথের জন্য ২০ টাকা ভাড়া নেওয়া হলো, কোনো সেবা পেলাম না, উল্টো আহত হলাম।”
আশরাফুল ইসলাম, যিনি আবুল হোটেল থেকে বসুন্ধরা যাতায়াত করেন, তিনি জানান, “ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম নেই। কন্ডাক্টররা নিজেদের ইচ্ছামতো আদায় করে। ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু হলে ভাড়া স্বচ্ছ হবে, ভোগান্তি কমবে।”
মালিক সমিতি এবং সরকারের ভূমিকা-
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম বলেন, “এসব বাস রাস্তায় চলতে দেওয়া উচিত নয়। আমরা চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, বাস শুধুমাত্র কাগজে ফিট থাকলেই হবে না। সিট, রঙ, ইন্ডিকেটর, গ্লাস সব ঠিক রাখতে হবে। অনেকে মানছেন না। তারা বাস চালকদের কাছে কন্ট্রাক্ট সিস্টেমে দিয়ে দিয়েছেন।”
তিনি আরো জানান, “এক-দেড় মাসের মধ্যে আমরা ই-টিকিটিং শুরু করব। স্টপেজে গাড়ি দাঁড় করানো হবে। আনফিট বাসগুলো রাস্তায় চলতে দেব না। মালিক, শ্রমিক ও পুলিশ মিলে এগুলো গ্যারেজে পাঠানো হবে, না হলে ডাম্পিং করা হবে।”
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, “সরকারকে শক্ত হাতে বাসের স্টিয়ারিং সিট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে সঠিক যাত্রীসেবা সম্ভব নয়। বাস-মালিক শুধু ব্যবসা চালিয়ে যাবে, যাত্রীদের কোনো লাভ হবে না।”
বিআরটিএ চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “বাসের সংখ্যা সড়কের তুলনায় বেশি। নতুন বাস না এনে পুরোনো বাস সরানো সম্ভব নয়। ঋণের মাধ্যমে নতুন বাস আনা হচ্ছে, যাতে পুরোনোগুলো প্রতিস্থাপন করা যায়। নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে, গাড়ি ডাম্পিং করা হচ্ছে।”
সঙ্কটের মূল কারণ-
রাজধানীর বাস পরিবহন সংকটের মূল কারণগুলো হলো:
- প্রশাসনিক দুর্বলতা– বিআরটিএ’র ফিটনেস পরীক্ষার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা দুর্বল। চোখে দেখে ফিটনেস দেওয়া হয়।
- ঘুষ এবং প্রভাবশালী মালিক সমিতি– বাস্তব ফিটনেস থাকা সত্ত্বেও ঘুষ না দিলে সার্টিফিকেট মিলছে না।
- যাত্রীদের সংখ্যা ও রাস্তার তুলনায় বাস বেশি– নতুন বাস না আনা পর্যন্ত পুরোনো বাস সরানো যায় না।
- ভাঙাচোরা এবং অস্বাস্থ্যকর ভেতরের পরিবেশ– সিট, লাইট, ফ্যান, জানালা নষ্ট, যাত্রীরা ঝুঁকির মুখে।
- ভাড়া সংক্রান্ত অগণিত অনিয়ম– কন্ডাক্টরদের ইচ্ছামতো ভাড়া আদায়। ই-টিকিটিং সীমিতভাবে চালু।
অর্থাৎ, বাসের ভাঙাচোরা অবস্থা, ঘুষের চক্র, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং মালিক-যাত্রী দ্বন্দ্ব একত্রিত হয়ে যাত্রীদের প্রতিদিনের যাত্রা বিপজ্জনক করছে।

আন্তর্জাতিক তুলনা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ-
উন্নত দেশে ফিটনেস পরীক্ষা কঠোর ও নিয়মিত। ব্যর্থ যানবাহন সরাসরি বাতিল হয়। এখানে সরকারি ও মালিক পক্ষের যোগসাজশে ফিটনেসবিহীন বাস চলাচল করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন:
- কঠোর নিয়ন্ত্রণ– বিআরটিএ-এর টেকনিক্যাল সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
- ঘুষের প্রথা বন্ধ করা– কোনো ফিটনেস নবায়ন ঘুষ ছাড়া সম্ভব হতে হবে।
- নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং ডাম্পিং– ঝুঁকিপূর্ণ বাস রাস্তায় চলতে না দিতে হবে।
- ই-টিকিটিং ব্যবস্থা– ভাড়া স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে।
- বাস প্রতিস্থাপন– নতুন বাস আনা এবং পুরোনো বাস সরানো।
- যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা– সিট, ফ্যান, লাইট, ব্রেক ঠিক রাখতে হবে।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, “সরকারকে শক্ত হাতে স্টিয়ারিং সিট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাস-মালিকদের ব্যবসা চালু রাখার বাইরে যেতে হবে। তবেই সঠিক যাত্রীসেবা সম্ভব।”
পরিশেষে, ঢাকার বাস পরিবহন ব্যবস্থা এখন ন্যূনতম সুরক্ষা ও মানের বাইরে। কাগজে ‘ফিট’ হলেও বাস্তবে বাসগুলো যাত্রীদের জীবনহানির ঝুঁকিতে রাখছে। প্রশাসনিক দুর্বলতা, ঘুষ, প্রভাবশালী মালিক সমিতি এবং যাত্রীদের সংখ্যা ও বাসের তুলনায় কম রাস্তা— এগুলো একত্রিত হয়ে প্রতিদিন বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।
বাস-মালিক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সরকার যদি সমন্বিতভাবে পদক্ষেপ নেয়, তাহলে কেবল যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়, বরং ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নও সম্ভব। নইলে কাগজে ‘ফিট’ বাস, বাস্তবে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রী পরিবহন অব্যাহত থাকবে।

