রাজধানীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে শুয়ে আছেন ৪৫ বছর বয়সী রিকশাচালক মো. হাফিজুল। এক মাস ধরে কাশি, শ্বাসকষ্ট ও বুক ব্যথায় ভুগে তিনি বাধ্য হয়েছেন হাসপাতালে ভর্তি হতে। প্রতিটি শ্বাসে তার বুক ভারী হয়ে ওঠে, চোখ-মুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। পাশে বসে থাকা স্ত্রী পাখা দিচ্ছেন অবিরাম, তবুও ঘামে ভিজে যাচ্ছে তার শরীর।
হাফিজুলের প্রতিদিনের জীবন যেন বিষাক্ত বাতাসে টিকে থাকার সংগ্রাম। রামপুরা-বাড্ডা এলাকার রাস্তায় ভোর থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালান। তিনি বললেন, “ভাই, সারাদিন রাস্তায় থাকি। একদিকে বাসের কালো ধোঁয়া, অন্যদিকে ধুলা। মুখে কাপড় বেঁধে রাখি, তারপরও ধোঁয়া গলায় ঢুকে যায়। বাসায় ফিরে দেখি শরীর ধুলায় মাখামাখি, চোখ-মুখ জ্বলে। রাতে ঘুমোতে গেলেও বুকটা চেপে আসে, মনে হয় কেউ যেন ভিতর থেকে টানছে।”
গত এক মাসে তিনবার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় তিনি হাসপাতালে এসেছেন। চিকিৎসকরা বিশ্রামের পরামর্শ দিলেও তিনি বলেন, “বিশ্রাম নিলে খাব কী দিয়ে? দুই দিন না চালালে সংসার চলে না। আবার রাস্তায় নামতে হয়… আবার ধোঁয়া গলায় ঢোকে।”

রিকশাচালক হাফিজুলের গল্প আসলে এই নগরের হাজারো শ্রমজীবী মানুষের বাস্তবতা। তারা প্রতিদিন ধোঁয়া-ধুলার মাঝে কাজ করে, বিষাক্ত বাতাসে বাঁচে, শ্বাস নেয়, আর ধীরে ধীরে ফুসফুসে জমা হয় রোগ। রামপুরা-বাড্ডা সড়কের মতো পুরো ঢাকা শহরজুড়ে একই চিত্র— লাখো মানুষ এখন শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, কাশি ও ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত।
ফিটনেসবিহীন যানবাহন রাজধানীর দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। এসব বাস ও ট্রাক থেকে নির্গত ঘন কালো ধোঁয়া প্রতিনিয়ত শহরের বাতাসে মিশছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার মোট বায়ুদূষণের ১৫ থেকে ২০ শতাংশের জন্য দায়ী এই যানবাহনগুলো।
শিশু ও প্রবীণরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে-
বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ফাতেহ আকরাম দোলন জানান, ঢাকার বাতাস এখন ‘বিষাক্ত’ পর্যায়ে পৌঁছেছে। “ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়ায় থাকা ক্ষুদ্র কণাগুলো ফুসফুসে জমে থেকে শ্বাসযন্ত্রকে ধীরে ধীরে অকেজো করে দিচ্ছে,” তিনি বলেন।
তার মতে, দূষিত বাতাস ও শব্দদূষণ শুধু শ্বাসযন্ত্র নয়, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, উদ্বেগ ও নিদ্রাহীনতার ঝুঁকিও বাড়ায়। “আমরা প্রতিদিন এমন রোগী পাচ্ছি যারা শহরের ধোঁয়া ও শব্দের কারণে শ্বাসকষ্ট, হাইপারটেনশন বা অনিদ্রায় ভুগছেন,” বলেন ডা. দোলন।
শিশু ও প্রবীণরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। শব্দদূষণ কানে স্থায়ী ক্ষতি, উদ্বেগ, মানসিক অস্থিরতা এবং হৃদ্রোগের আশঙ্কা তৈরি করছে। অপরদিকে, কালো ধোঁয়ায় থাকা ক্ষতিকর কণা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD) ও ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চারপাশেই শব্দের তাণ্ডব-
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)–এর এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর ১২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো এলাকাতেই শব্দের মাত্রা নিরাপদ সীমার মধ্যে নেই। বিএএফ শাহীন কলেজ ও কিডস টিউটোরিয়াল স্কুলের সামনে শব্দের মাত্রা ছিল ১০০.৭৬ ডেসিবেল— যা আন্তর্জাতিক মানের প্রায় দ্বিগুণ। গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের সামনেও ছিল যথাক্রমে ৯৩.০৪ ও ৯২.৯২ ডেসিবেল।
এছাড়া ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও খিলগাঁও সরকারি কলেজসহ আরও বহু প্রতিষ্ঠানের সামনের শব্দমাত্রা ছিল ৮৮ ডেসিবেলের ওপরে। সরকারি মান অনুযায়ী ‘নীরব এলাকা’তে দিনের সর্বোচ্চ সীমা ৫০ ডেসিবেল এবং রাতে ৪০ ডেসিবেল হলেও ঢাকার ৪৭টি স্কুল ও কলেজে তা ৮০ ডেসিবেলেরও বেশি।
পরিবেশবিদরা সতর্ক করেছেন— এ ধরনের শব্দদূষণ শিশুদের শ্রবণশক্তি নষ্ট করছে, মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে এবং হৃদ্রোগের সম্ভাবনাও তৈরি করছে।

নির্মল বাতাসে এক দিনও শ্বাস নয়-
ক্যাপস–এর বায়ুদূষণ গবেষণায় আরও জানা যায়, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ঢাকার বায়ুমান সূচক (একিউআই) ক্রমাগত খারাপ হয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে এক দিনও রাজধানীবাসী নির্মল বায়ুতে শ্বাস নিতে পারেননি। ওই মাসে ১৩ দিন ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ ও ১২ দিন ‘অস্বাস্থ্যকর’ ছিল।
২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের নভেম্বরে ঢাকার গড় একিউআই ১১ শতাংশ বেড়ে ১৯৫-এ দাঁড়িয়েছে— যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত নিরাপদ সীমার তিনগুণ। গবেষণায় দেখা গেছে, নভেম্বর, ডিসেম্বর ও ফেব্রুয়ারিতে দূষণ সবচেয়ে বেশি থাকে, যেখানে একিউআই ১৭৭ থেকে ২২১ পর্যন্ত ওঠানামা করে।
দূষণের মূল উৎস: ফিটনেসবিহীন যান ও ধুলাবালি-
পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদারের মতে, বর্ষা শেষে বায়ুমানের অবনতি দ্রুত ঘটে কারণ বৃষ্টি না থাকলে ধুলিকণা বাতাসে ঝুলে থাকে। “মোট যানবাহনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ফিটনেসবিহীন— সংখ্যায় প্রায় ছয় থেকে সাত লাখ। এই যানগুলো দূষণের প্রধান উৎস,” তিনি বলেন।
তিনি মনে করেন, সরকারের উচিত ছিল এসব যানবাহন পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা, কিন্তু বাস্তবে কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। “দূষণকারীদের একটি সিন্ডিকেট আছে, ফলে সরকার একা সফল হতে পারেনি,” বলেন ড. কামরুজ্জামান।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে মোট বায়ুদূষণের ১৫-২০ শতাংশ আসে এই যানবাহনগুলো থেকে। এগুলো সরাসরি জনস্বাস্থ্যের ওপর আঘাত হানছে, বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষের ওপর। তিনি বলেন, “ফার্মেসিগুলোতে ইনহেলার বিক্রির সংখ্যা বেড়েছে— এটি দূষণের সরাসরি প্রমাণ।”

সরকারী উদ্যোগে শিথিলতা, পরিস্থিতি ‘অশনি সংকেত’-
সরকার একাধিকবার পুরোনো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি পর্যায়ক্রমে নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল— ২০২৪ সালের জুলাই ও ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এমন ঘোষণা আসে। কিন্তু বাস্তবে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সেই কঠোরতা হ্রাস পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শিথিলতা ভবিষ্যতের জন্য ‘অশনি সংকেত’।
ড. কামরুজ্জামান বলেন, “ঢাকার দূষণ নিয়ন্ত্রণে গঠিত টাস্কফোর্সের প্রতি মাসে বৈঠক করার কথা থাকলেও গত আট-নয় মাসে মাত্র দুটি বৈঠক হয়েছে। দেওয়া পরামর্শও বাস্তবায়িত হয়নি।”
দূষণের অর্থনৈতিক মূল্য-
অর্থনীতিবিদ সৈয়দ আব্দুল হামিদের মতে, বায়ুদূষণের কারণে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ক্ষতি হচ্ছে ৩.৯ থেকে ৪.৪ শতাংশ পর্যন্ত। “এই ক্ষতির দুটি মূল কারণ— স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস,” বলেন তিনি।
তিনি আরও জানান, দূষণজনিত অসুস্থতার কারণে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ কর্মদিবস নষ্ট হচ্ছে এবং মানুষের গড় আয়ুষ্কাল কমছে ৫.৪ বছর পর্যন্ত। “ঢাকার বাতাস এতটাই খারাপ যে এটি বাসযোগ্য নয়,” বলেন তিনি।
তার মতে, ঢাকায় দূষণের দুটি উৎস— ঘরের ভেতরের দূষণ ও বাইরের উন্মুক্ত দূষণ। শহরের ক্ষেত্রে বাহ্যিক দূষণই সবচেয়ে বড় হুমকি।
নগর পরিকল্পনায় ব্যর্থতা-
ঢাকায় সবুজায়নের অভাব ও পার্ক ধ্বংস দূষণকে তীব্র করছে। মেট্রোরেল নির্মাণকাজে রোড ডিভাইডারের গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, নতুন কোনো পার্ক গড়ে তোলা হয়নি। সাভার ও আশপাশের ইটভাটা, নির্মাণকাজের ধুলা এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহনের ধোঁয়া— সব মিলে শহরের বাতাস এখন মৃত্যুঝুঁকি ডেকে আনছে।

পরিবেশ রক্ষায় ব্যর্থতা স্বীকার-
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “পরিবেশ রক্ষায় জাতি হিসেবে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের অগ্রাধিকার প্রকৃতিকেন্দ্রিক হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, “যখন ১৮০ দেশের মধ্যে আপনার পরিবেশগত কার্যক্ষমতা ১৭৯তম স্থানে, তখন সেটাকে ৫০ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া কঠিন। কিন্তু আমরা চেষ্টা না করলে এগোনো সম্ভব নয়।”
পরিশেষে, ঢাকার বায়ুদূষণ এখন নীরব মৃত্যুর সমার্থক। প্রতি নিঃশ্বাসে বিষ, প্রতি পদক্ষেপে শব্দ— এমন বাস্তবতায় নগরজীবন টিকে আছে কেবল অভ্যাসে। কিন্তু এই অভ্যাসের মূল্য দিচ্ছে জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। গবেষণা, চিকিৎসক ও পরিবেশবিদদের এক কথাই— এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে, এই শহর শ্বাস নিতে পারবে না একদিন।

