বাংলাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম রেল অঞ্চলের প্রায় ৬৪ শতাংশ রেলপথ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় ট্রেন চলাচলে এই রেলপথগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নতুন প্রকল্প নেওয়ার পরও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নজর মূলত নতুন উন্নয়ন প্রকল্পে থাকায় পুরনো রেলপথ ও সেতুর সংস্কার প্রক্রিয়া অনেকাংশে অবহেলিত রয়েছে।
রেলওয়ের পরিকল্পনা, অপারেশন ও প্রকৌশল দপ্তর সূত্র জানায়, গত দেড় দশকে রেল খাতে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবুও, জরাজীর্ণ রেলপথ এবং প্রাচীন রেল সেতু যথাযথভাবে মেরামত করা হয়নি। এর ফলে দেশের কিছু অংশে ট্রেন চলাচলের গতি সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ শতাংশে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে রেলপথের প্রতি বছর গড়ে ৮৩ শতাংশে ট্রেনের লাইনচ্যুতি ঘটছে। পূর্ব ও পশ্চিম রেল অঞ্চলের অধীনে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৩ জেলায় রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে ৩৯ জেলার রেলপথের বিভিন্ন অংশ নাজুক অবস্থায় আছে। বিশেষ করে পর্যাপ্ত পাথর না থাকা, মাটি সরে যাওয়া ও বিভিন্ন নির্মাণগত সমস্যার কারণে এই ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দেশে মোট তিন হাজার ৯৩ কিলোমিটার রেলপথ আছে। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের রেলপথের অবস্থা খারাপ। ৪০০ কিলোমিটার অংশে লোহার পাত বদলাতে হবে এবং প্রায় ২০০ কিলোমিটারে স্লিপার পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। শুধু পূর্ব রেলেই পাঁচ লাখ কিউবিক মিটার পাথরের ঘাটতি আছে।
রেলপথের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার কারণে সাধারণ যাত্রী ও মালবাহী ট্রেনের নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে। বিশেষ করে আখাউড়া-সিলেট, ময়মনসিংহ-জয়দেবপুর, জামালপুর-তারাকান্দি, ভৈরব-কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন সেকশনের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। কিছু রেলপথে পর্যাপ্ত নুড়িপাথর নেই, কোথাও লাইনের নিচের মাটি সরে গেছে, আবার কোথাও হুক বা নাট-বল্টুও নেই।
রাজশাহী-আব্দুলপুর রেলপথের ৪৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৩৫ কিলোমিটার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ১৯৬২ সালের পর এ অংশে তেমন সংস্কার করা হয়নি। সম্প্রতি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বালুদিয়াড়ে রেলপথের দুই ফুট ভেঙে গেলে স্থানীয় গ্রামবাসী আলো জ্বালিয়ে ও লাল কাপড় দেখিয়ে খুলনা থেকে রাজশাহীগামী সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস ট্রেন থামিয়ে দেয়। না হলে প্রায় ৭০০ যাত্রী সমেত ট্রেনটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ত।
পশ্চিম রেলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আহসান জাবির জানিয়েছেন, ঝুঁকিপূর্ণ অংশগুলো মেরামত করে ট্রেন চলাচল অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে জনবল সংকট, বাজেট ঘাটতি এবং অপরিকল্পিত রক্ষণাবেক্ষণের কারণে কাজ ধীরগতি হচ্ছে।
সিলেট-আখাউড়া রেলপথে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত বহু সেতু ও রেলপথ এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে। বিভিন্ন অংশে ফিসপ্লেট ও নাট-বল্টু অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে, পাথর ও স্লিপার নেই। এর ফলে গত ২০ বছরে এই সেকশনে অর্ধশতাধিক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে।
পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী তানভীরুল ইসলাম বলেন, “যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ আছে, সেগুলো দ্রুত সংস্কারের প্রয়োজন। তবে বাজেট সীমাবদ্ধতার কারণে সম্পূর্ণ মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না।”
রেলপথের এই নাজুক অবস্থা প্রমাণ করছে, শুধু নতুন প্রকল্প নয়, পুরনো রেলপথ ও সেতুর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণই দেশের ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাকে নিরাপদ রাখতে অপরিহার্য।