বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। সমুদ্রের ভেতর পর্যন্ত সম্প্রসারিত রানওয়ের কারণে এই বিমানবন্দরটি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় ছিল। তবে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—কবে থেকে এখানে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হবে এবং কোন কোন গন্তব্যে বিমান চলাচল শুরু হবে।
রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে কক্সবাজার-ঢাকা-কলকাতা রুটে ফ্লাইট চালুর বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা চলছে। তবে সংস্থাটি জানিয়েছে, এখনো বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক কোনো এয়ারলাইন্স থেকেও এখন পর্যন্ত কক্সবাজার বিমানবন্দর ব্যবহারের জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন আসেনি। এমনকি অভ্যন্তরীণ রুটে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনাকারী স্থানীয় এয়ারলাইন্সগুলোও এখনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনায় আগ্রহ দেখায়নি।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য শুধু ঘোষণা নয়, যাত্রী চাহিদা, বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ও আন্তর্জাতিক চুক্তিগত অনুমোদনও জরুরি। অনেক এয়ারলাইন্স মনে করছে, কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে পর্যাপ্ত যাত্রী পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। যদিও রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তারা নিয়মিত কক্সবাজারে যাতায়াত করেন, যা আংশিকভাবে যাত্রী চাহিদা বাড়াতে পারে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক গোলাম মোর্তুজা হোসাইন জানিয়েছেন, বিমানবন্দরটি এখন আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। তাঁর ভাষায়, “কর্তৃপক্ষ চাইলে এখনই আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল শুরু করা সম্ভব।”
তবে এভিয়েশন বিশ্লেষকদের একটি বড় অংশ বলছে, বাংলাদেশের অন্যান্য দেশের সঙ্গে যেসব এয়ার সার্ভিস অ্যাগ্রিমেন্ট (Air Service Agreement) আছে, সেখানে কক্সবাজার বিমানবন্দরের নাম এখনো অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবেই তালিকাভুক্ত। তাই কক্সবাজারকে এই তালিকায় যুক্ত না করা পর্যন্ত বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো এখান থেকে ফ্লাইট চালু করতে পারবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চালু করতে হলে যাত্রী সংখ্যা, কার্গো পরিবহন সুবিধা ও বাণিজ্যিক টেকসইতা—সব দিক যাচাই করে দেখবে এয়ারলাইন্সগুলো। তবেই বোঝা যাবে, কক্সবাজার বিমানবন্দর সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারছে কি না।
বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার যাত্রী কক্সবাজার বিমানবন্দর ব্যবহার করেন। আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ভবনের কাজ সম্পন্ন হলে বছরে প্রায় ১৮ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা তৈরি হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। নতুন টার্মিনাল ভবনের নির্মাণ কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে।

আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও প্রাথমিক অবকাঠামো-
গত ১২ অক্টোবর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক ঘোষণা দেয়। যদিও বিমানবন্দরের নতুন ১১ হাজার বর্গফুট আয়তনের টার্মিনাল ভবনের নির্মাণকাজ তখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি।
এর আগে ২০২১ সালের আগস্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দরটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্প উদ্বোধন করেন। এখন বিমানবন্দরটির রানওয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ—যা আন্তর্জাতিক উড়োজাহাজ পরিচালনার জন্য অপরিহার্য।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, “একটি বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিতে হলে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতে হবে। যাত্রী আগমন ও বহির্গমন পথ আলাদা থাকা জরুরি, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্র পৃথক হতে হবে এবং যথাযথ কার্গো সুবিধাও থাকতে হবে।”
এই শর্তগুলো পূরণ করলেই আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (ICAO) ‘অ্যারোড্রোম সার্টিফিকেট’ পাওয়া যায়, যা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য অপরিহার্য। নিরাপত্তা ও সেবা মান যাচাই করে আইসিএও বিশেষজ্ঞরাই এই সনদ প্রদান করে থাকে।
দেশের বিদ্যমান সিভিল এভিয়েশন আইনেও বলা হয়েছে, কোনো বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহারের আগে অ্যারোড্রোম সনদ নিতে হবে। কক্সবাজার বিমানবন্দরের বাণিজ্যিক ফ্লাইট শুরু হলে সেই সনদ নেওয়াও বাধ্যতামূলক হবে।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রকল্প-
২০২১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের আওতায় রানওয়ের দৈর্ঘ্য ৬,৭৭৫ ফুট থেকে বাড়িয়ে ৯,০০০ ফুট করা হয় এবং প্রস্থ ১৫০ ফুট থেকে ২০০ ফুটে উন্নীত করা হয়। পাশাপাশি রানওয়ের শক্তি বৃদ্ধি, আধুনিক এয়ারফিল্ড লাইটিং সিস্টেম, ফায়ারফাইটিং যান, যোগাযোগ ও ন্যাভিগেশন যন্ত্রপাতি—সবকিছুই আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
আরেকটি চলমান প্রকল্পের অধীনে রানওয়ে সমুদ্রের ভেতরে সম্প্রসারণ শেষে মোট দৈর্ঘ্য হবে ১০,৭০০ ফুট, যা দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম রানওয়েগুলোর একটি হবে।
চলতি বছরের মার্চে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কক্সবাজার বিমানবন্দরের কাজ পরিদর্শনে গেলে কর্মকর্তারা জানান, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হলে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০টি উড়োজাহাজ ওঠানামা করবে।
যদিও তখন জানানো হয়েছিল, ডিসেম্বরের মধ্যে সব কাজ শেষ হবে, কিন্তু এর আগেই—অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে—সরকার বিমানবন্দরটিকে আন্তর্জাতিক ঘোষণা দেয়।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীনও সম্প্রতি বলেছেন, “একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট দিয়েই যাত্রা শুরু হবে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের, পরবর্তীতে ধাপে ধাপে যুক্ত হবে আরও ফ্লাইট।”
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও প্রয়োজনীয়তা-
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলমের মতে, একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কমপক্ষে ১০ হাজার ফুট রানওয়ের পাশাপাশি রিফুয়েলিং ফ্যাসিলিটি থাকা আবশ্যক। এছাড়া টার্মিনালে পর্যাপ্ত লাউঞ্জ, ডিউটি ফ্রি শপ, চেক-ইন কাউন্টার, কাস্টমস স্টেশন, ব্যাগেজ বেল্ট, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সরঞ্জাম ও অভিজ্ঞ অপারেটর নিশ্চিত করতে হয়।
তিনি বলেন, “বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর উড়োজাহাজ যেন নির্বিঘ্নে অবস্থান ও ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারে, সেটিই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সক্ষমতার আসল পরীক্ষা।”
বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক গোলাম মোর্তুজা হোসাইন জানিয়েছেন, এসব সুবিধা এখন কক্সবাজারে প্রস্তুত রয়েছে। রানওয়ে, ইমিগ্রেশন, কাস্টমস, ট্যাক্সিওয়ে, আলোকসজ্জা, ন্যাভিগেশন সুবিধা, কোয়ারেন্টাইন, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এবং কার্গো সেবাসহ সব ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

যাত্রী চাহিদা ও এয়ারলাইন্সের অনিশ্চয়তা-
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবকাঠামোগত প্রস্তুতি থাকলেও যাত্রী চাহিদা নির্ভরযোগ্যভাবে নির্ধারণ না করা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক রুট চালু করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এয়ারলাইন্সগুলো লাভজনকতার বিষয়টি আগে বিবেচনা করবে।
এয়ার অ্যাস্ট্রার প্রধান নির্বাহী ইমরান আফিস বলেন, “বিমানবন্দর সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত যাত্রী প্রবাহের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা। কক্সবাজার থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ফ্লাইট চালু করা হলে আগে যাচাই করতে হবে, সপ্তাহে তিন-চারটি ফ্লাইট চালানোর মতো যাত্রী পাওয়া যাবে কি না।”
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র বসরা ইসলাম জানিয়েছেন, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালুর পরই ঢাকা-কলকাতা-কক্সবাজার রুটে ফ্লাইট চালুর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অন্যদিকে, একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স কক্সবাজার-ঢাকা-ব্যাংকক রুটে ফ্লাইট পরিচালনার প্রস্তুতি নিলেও তারা এখনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়নি।
আন্তর্জাতিক তালিকায় নাম যুক্ত হওয়া জরুরি-
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিকভাবে কার্যকর করতে হলে প্রথমে আন্তর্জাতিক এয়ার সার্ভিস চুক্তিতে (Air Service Agreement) ‘অরিজিন পয়েন্ট’ হিসেবে এর নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তা না হলে আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সগুলোর পক্ষে এখান থেকে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করা সম্ভব হবে না।
ফলে কক্সবাজার বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর ঘোষণা বাস্তবায়ন নির্ভর করছে একদিকে অবকাঠামোগত মানোন্নয়ন ও সরকারি অনুমোদনের ওপর, অন্যদিকে বিদেশি এয়ারলাইন্স ও যাত্রী চাহিদার নিশ্চয়তার ওপর।
যদিও সরকার বিমানবন্দরটিকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিয়েছে, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠবে কেবল তখনই, যখন এখান থেকে নিয়মিত আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ওঠানামা শুরু হবে।

