দেশের অর্থনীতি সচল থাকার অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এই রেমিট্যান্সের বড় অংশই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। তার মানে প্রবাসীদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষের গন্তব্যস্থান মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো। সেখানে যেতে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি তথাকথিত ‘ফ্রি ভিসা’ নামক এক ভয়াবহ প্রতারণার শিকার হয়ে আসছেন দিনের পর দিন।
অভিবাসীবিষয়ক সংস্থা ও সংগঠনগুলো এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে এলেও তা গুরুত্বহীন থেকে গেছে।
আইএলও কনভেনশন অনুসারে ফ্রি ভিসা বলে কিছু নেই। এটি মূলত একধরনের প্রতারণামূলক চুক্তি, যেটির মাধ্যমে কর্মীকে কোনো দেশে শুধু প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় বা স্পনসরশিপ বিক্রি করা হয়, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট চাকরির ব্যবস্থা থাকে না। দেশের অনেক মানুষ কাজের সন্ধানে যেকোনো উপায়ে বিদেশে যেতে চান। তখন অতিরিক্ত খরচে ফ্রি ভিসা নিয়ে বিদেশে গিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন তাঁরা।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) একটি গবেষণা রিপোর্ট জানাচ্ছে, সরকার নির্ধারিত খরচের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ খরচ করেও অনেক শ্রমিক কাজের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না। এটি প্রমাণ করে, বিদেশে মানবসম্পদ পাঠানোর প্রক্রিয়াটি অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দালাল চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে আছে।
ফ্রি ভিসা নিয়ে বিদেশে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে ওকাপ দেখেছে, বিদেশে যাওয়ার খরচ জোগান দিতে ৭২ শতাংশ কর্মী ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছেন, ১১ শতাংশ জমি বন্ধক রেখেছেন এবং ৬ শতাংশ পারিবারিক সম্পদ (জমি) বিক্রি করেছেন। এত ত্যাগের পর গন্তব্যে পৌঁছে ৪৩ শতাংশ কর্মী কাজ পাননি।
এই অবৈধতার জন্ম হচ্ছে দেশে থাকা শক্তিশালী দালাল নেটওয়ার্ক ও একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো আইনত বৈধ হলেও মাত্র ৭ শতাংশ কর্মী সরাসরি তাদের মাধ্যমে গেছেন। এর মধ্য দিয়ে দালালদের প্রভাবের মাত্রার বিষয়টি প্রকাশ পায়।
উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ের জন্য দায়ী দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ও দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার নির্ধারিত অভিবাসন খরচ বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি এবং এর লঙ্ঘনে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু বেশিসংখ্যক কর্মী পাঠানো নয়; বরং দক্ষ কর্মী তৈরির প্রশিক্ষণে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
এতে কর্মীরা উচ্চ বেতনে কাজ পাবেন এবং প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি কমবে। ফ্রি ভিসা যে আসলে ফ্রি নয়, বরং বড় ধরনের ফাঁদ, এ বিষয়ে তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। অভিবাসনপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও জবাবদিহির মধ্যে আনতে সরকার আন্তরিক হলে তবেই কেবল দেশের লাখো কর্মীর রক্ত-ঘামের দামে কেনা অনিশ্চিত জীবন থেকে মুক্তি মিলতে পারে।
সূত্র: প্রথম আলো

