সুন্দরবনের দুবলারচরে আজ রোববার থেকে শুঁটকি উৎপাদনের মৌসুম শুরু হচ্ছে। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে গতকাল শনিবার মধ্যরাত থেকে শত শত ট্রলারে যাত্রা করেছেন জেলেরা। তারা বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় বিভিন্ন চরে গিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাছ আহরণ করে শুঁটকি তৈরি করবেন।
কিন্তু কয়েক মাস ধরে সুন্দরবনকেন্দ্রিক জলদস্যুরা বেপরোয়া হয়ে ওঠায় জেলেরা আতঙ্কে রয়েছেন। শুঁটকি মৌসুমের শুরুতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বন বিভাগ ইতোমধ্যেই কোস্ট গার্ডকে চিঠি দিয়েছে।
কোস্ট গার্ডসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনে বর্তমানে ১৪টি জলদস্যু বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুলাভাই বাহিনী, মজনু বাহিনী, অয়ন কোম্পানি, আবু সালেহ কোম্পানি, হোসেন কোম্পানি, শহিদুল কোম্পানি, কামরুল কোম্পানি, বিপুল কোম্পানি, মিন্টু কোম্পানি, রিয়াসাদ কোম্পানি, খোকন কোম্পানি এবং শাহীন কোম্পানি।
বিকাশ কোম্পানি মজনু ডাকাতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। বিকাশ মারা যাওয়ার পর কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণ এখন তাঁর স্বজনদের হাতে। ইলিয়াস বাহিনীর প্রধান ইলিয়াসের মৃত্যুর পর দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর বোনের স্বামী রবিউল, যিনি দুলাভাই নামে পরিচিত।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উল্লেখ করেছেন, মজনু, করিম শরীফ, দয়াল, রবিউল, আবদুল্লাহ, মামা-ভাগনে, আসাবুর, দুলাভাই, আল-আমীন, জাহাঙ্গীর, আফজাল, কাজল-মুন্না, রাঙ্গা ও ছোট সুমন বাহিনী জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। এর মধ্যে সাতটি বাহিনী নতুন।
কোস্ট গার্ড জানায়, আল-আমীন আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু ১৮ এপ্রিল অস্ত্রসহ ধরা পড়ার পর জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার বনে সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৮ সালে আত্মসমর্পণ করা করিম শরীফও আবার দস্যুতায় ফিরেছেন। মুন্সিগঞ্জের মিলন পাটোয়ারী মজনু বাহিনীর সঙ্গে দস্যুতায় ফিরে এসেছেন। শ্যামনগরের খোকাবাবুও আবার দস্যুতায় নেমেছেন।
আসাবুর বাহিনীর প্রধান আসাবুর সানাসহ দুই ডাকাতকে গত বছরের ১২ নভেম্বর সুন্দরবনের ঠাকুরবাড়ি ঘাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারও অস্ত্র হাতে বনে নেমেছেন। গত ৪ আগস্ট শিবসা নদীর শরবতখালী এলাকা থেকে আসাবুরের দুই সহযোগীকে আটক করা হলেও আসাবুর পালিয়ে যান।
কোস্ট গার্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে সুন্দরবনে ১৮ দস্যু গ্রেপ্তার এবং ১৬টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২২৮টি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। ১২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
শনিবার দুপুরে ২২ দিনের ইলিশ শিকারের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর জেলে ও শ্রমিকরা নৌকা নিয়ে সুন্দরবনসংলগ্ন মোংলা উপজেলার মোংলা নদী ও পশুর নদে জড়ো হন।
বাগেরহাটের রায়েন্দার জেলে মহাজন আবুল হোসেন বলেন, ‘২০১৮ সালে জলদস্যুরা আত্মসমর্পণ করার পর কয়েক বছর সুন্দরবন ও সাগরে অনেকটা শান্তি ছিল। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকে আবার দস্যুতা বেড়ে গেছে। গত বছরও জেলেদের জিম্মি করে পৌনে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় হয়েছে। আমরা ভয় পাচ্ছি।’
জেলে আবদুর জব্বার বলেন, ‘চলতি চার-পাঁচ মাসের মাছ আহরণের আয় দিয়ে আমাদের পুরো বছরের সংসার চলে। কিন্তু বনে বাঘ ও দস্যুতা বেড়ে যাওয়ায় আমরা আতঙ্কিত। আমাদের ভাগ্যে কী আছে, জানি না।’
দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘শুধু জলদস্যু নয়, কিছু রাজনৈতিক পরিচয়ের লোকও অবৈধ সুবিধা নিতে দুবলারচরে আধিপত্য বিস্তার করছে। সুন্দরবনে দস্যুতাও বেড়েছে। তাই আমরা কোস্ট গার্ডকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।’
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘২৬ অক্টোবর থেকে দুবলারচরে শুঁটকি মৌসুম শুরু হবে। শেষ হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি। চার মাস জেলেরা দুবলারচর, আলোরকোল, অফিসকেল্লা, নারকেলবাড়িয়া ও শেলারচরে অবস্থান করবেন। চরগুলোতে জেলেদের থাকার জন্য ৯০০টি ঘর ও ৮০টি দোকান অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মাছ বেচার জন্য ১০০টি ডিপো তৈরি করা হবে। তবে বনের গাছ কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না।’
গত মৌসুমে শুঁটকি থেকে বন বিভাগ ৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছিল। এবার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ কোটি টাকারও বেশি।
কোস্ট গার্ডের লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়াম-উল-হক বলেন, ‘দস্যুদের রুখে দেওয়ার পাশাপাশি ধারাবাহিক অভিযান চলছে। অপহৃত জেলে ও বাওয়ালিকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।’
রেজাউল করিম চৌধুরী আরও বলেন, ‘গত বছর শুঁটকি মৌসুমে দস্যুতা বেশি ছিল। তাই আমরা বন ও কোস্ট গার্ডের প্রস্তুতি নিয়েছি। মৌখিকভাবে র্যাবেরও সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।’

