দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মানুষ এখন এক কঠিন সময় পার করছেন। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও চালু করা যায়নি বড়পুকুরিয়ার কয়লাভিত্তিক ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি। ফলে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, আর এর প্রভাব পড়ছে পার্বতীপুরসহ উত্তরাঞ্চলের আট জেলায়।
প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় গ্রামীণ মানুষ থেকে শুরু করে চালকল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান—সবখানেই নেমেছে নীরব অচলাবস্থা।
গত ১৬ অক্টোবর কেন্দ্রটির তৃতীয় ইউনিটে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এরপর ১৯ অক্টোবর বন্ধ হয়ে যায় প্রথম ইউনিটও। ফলে পুরো কেন্দ্রের উৎপাদন থেমে যায়।
প্রথম ইউনিটের উৎপাদনক্ষমতা ছিল ১২৫ মেগাওয়াট, আর তৃতীয় ইউনিটটি দিচ্ছিল ১৬০ থেকে ১৬৫ মেগাওয়াট পর্যন্ত। এখন দুটোই নিস্তব্ধ।
এর আগে থেকেই দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০২০ সালের নভেম্বরে বন্ধ হয়ে আছে—প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল। সেটি পুনরায় চালুর কাজ এখনও শেষ হয়নি।
কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিক জানিয়েছেন, “প্রথম ইউনিটটি চালু করতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে। তবে তৃতীয় ইউনিট চালু করতে আরও সময় লাগবে, কারণ অনেক যন্ত্রাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। ভুলভাবে চালু করলে বড় ক্ষতি হতে পারে।”
চীনা প্রতিষ্ঠান হারবিন ইন্টারন্যাশনাল এই কেন্দ্রের মূল প্রস্তুতকারক। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখন শুধু দ্বিতীয় ইউনিট মেরামত করতে প্রতিষ্ঠানটি ২৩ মিলিয়ন ডলার দাবি করছে—যেখানে আগে পুরো দুটি ইউনিট স্থাপনে ব্যয় হয়েছিল ২২ মিলিয়ন ডলার!
অর্থের এই বিশাল অঙ্কই কেন্দ্রটি পুনরায় চালুর পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংকট এখন চোখে পড়ার মতো। পার্বতীপুর শহরে যেখানে প্রতিদিন সাত মেগাওয়াটের চাহিদা, সেখানে নেসকো সরবরাহ করতে পারছে সর্বোচ্চ তিন মেগাওয়াট।
গ্রামে তো অবস্থা আরও খারাপ। সকাল, ভোর কিংবা গভীর রাত—যেকোনো সময় বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মালেকের ক্ষোভ, “এখন বিদ্যুৎ গেলেই মনে হয়, কবে আবার আসবে কে জানে! গরমে থাকা যায় না, কাজকর্ম সব বন্ধ।”
চালকল মালিক থেকে শুরু করে কৃষক—সবাই দুশ্চিন্তায়। আসন্ন বোরো মৌসুমে সেচের জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ না পেলে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক সহিদুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, “এই কেন্দ্রটি উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও শিল্পের প্রাণ। এটি বন্ধ থাকলে শুধু বিদ্যুৎ নয়—কৃষি, চালকল, এমনকি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাও বিপর্যস্ত হবে।”
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে বর্তমানে প্রায় ৪ লাখ ৬০ হাজার টন কয়লা মজুত আছে। কিন্তু কয়লা থাকার পরও উৎপাদন বন্ধ—কারণ যন্ত্রাংশের ত্রুটি আর মেরামতের বিলম্ব।
একসময়ের গর্বের কেন্দ্রটি আজ যেন পরিণত হয়েছে “যান্ত্রিক ব্যর্থতার” প্রতীকে।
২০০৬ সালে যখন কেন্দ্রটি চালু হয়, তখন আশা ছিল—উত্তরাঞ্চলের মানুষ আর কখনও অন্ধকারে থাকবে না। কিন্তু ২০২৫ সালে এসে বাস্তবতা উল্টো—সেই কেন্দ্রই এখন উত্তরবঙ্গের ঘরে ঘরে অন্ধকার বইয়ে দিচ্ছে।

