নভেম্বরের প্রথম দিন থেকে পর্যটকদের জন্য আবার খুলছে বঙ্গোপসাগরের প্রবালসমৃদ্ধ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। তবে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, পর্যটকদের জন্য কঠোরভাবে ১২টি নিয়ম মানা বাধ্যতামূলক। প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক দ্বীপে যেতে পারবেন।
সরকারি প্রজ্ঞাপনের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে পর্যটকরা শুধু দিনের বেলায় দ্বীপ ভ্রমণ করতে পারবেন, রাত যাপন নিষিদ্ধ। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে রাতযাপনের সুযোগ মিলবে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ১২টি নির্দেশনা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবেন।
পর্যটকদের জন্য মূল ১২টি নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে:
- রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি বা বারবিকিউ পার্টি নিষিদ্ধ।
- কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা ক্রয়–বিক্রয় নিষিদ্ধ।
- সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি নিষিদ্ধ।
- সৈকতে মোটরসাইকেল, সি-বাইকসহ মোটরচালিত যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ।
- নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (নভেম্বর: শুধু দিনের বেলায়, ডিসেম্বর–জানুয়ারি: রাতযাপন সম্ভব) দ্বীপে থাকতে হবে।
- বিআইডব্লিউটিএ এবং মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ।
- টিকিট অবশ্যই বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে কিনতে হবে।
- কিউআর কোড ছাড়া টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে।
- নিষিদ্ধ পলিথিন বহন করা যাবে না।
- একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক (চিপসের প্যাকেট, চামচ, স্ট্র, সাবান, শ্যাম্পু ৫০০–১০০০ মিলিলিটার ইত্যাদি) বহন নিরুৎসাহিত।
- পর্যটকদের নিজস্ব পানির ফ্লাস্ক সঙ্গে রাখতে হবে।
- জেলা প্রশাসন নির্দেশনা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবেশ সংকটাপন্ন সেন্ট মার্টিনে প্রবাল, শৈবাল, কাছিম, শামুক, ঝিনুক, সামুদ্রিক মাছ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, কাঁকড়াসহ ১ হাজার ৭৬ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে। অতীতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, বিপুল পর্যটকের সমাগম ও পরিবেশদূষণের কারণে দ্বীপটি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। তবে গত ৯ মাস সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের যাতায়াত বন্ধ থাকায় দ্বীপের জীববৈচিত্র্য বিস্তার ও পরিবেশের উন্নতি হয়েছে।
সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের জারি করা ১২টি নির্দেশনা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করবে জেলা প্রশাসন। আগে টেকনাফ থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করলেও নিরাপত্তার কারণে এখন কক্সবাজার শহর থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেন্ট মার্টিন যাতায়াত করবে।
মো. আবদুল মান্নান, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক
‘সেন্ট মার্টিনের দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অভিযোজন প্রকল্প’ নামে ৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার একটি প্রকল্পের কাজ চলছে দ্বীপটিতে।
এ প্রকল্পের পরিচালক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, ছেঁড়াদিয়া, গোলদিয়া ও দিয়ারমাথা পরিদর্শন করে তিনি প্রবাল-শৈবাল বিস্তারের দৃশ্য দেখেছেন। শৈবাল ও চুনাপাথরের গায়ে অজস্র শামুক-ঝিনুক আঁকড়ে আছে। বালুচরে শামুক-ঝিনুকের বিচরণ চোখে পড়েছে। বালিয়াড়িতে প্যারাবন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। প্যারাবনে ব্যাঙ, সাপ, টিকটিকি, প্রজাপতিসহ বিভিন্ন প্রাণীর বিচরণ দেখা গেছে, যা দুই বছর আগে ছিল না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ মাস পর্যটকবিহীন থাকার কারণে দ্বীপের পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। লাল কাঁকড়া ও শামুক-ঝিনুকের বংশবিস্তার ঘটেছে, মা কাছিম নিরাপদে ডিম পাড়তে পারছে। দ্বীপের প্রবাল, শৈবাল ও অন্যান্য সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
পর্যটক সীমিত করার উদ্যোগের প্রথম ৯ মাসে সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ-প্রতিবেশের ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। এখন সৈকতজুড়ে লাল কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকের বংশবিস্তার ঘটেছে। সৈকতে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় না থাকায় মা কাছিমের ডিম পাড়ার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
ইব্রাহিম খলিল, ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী
তবে পর্যটক না থাকার কারণে দ্বীপের কয়েক হাজার মানুষ আর্থিক সমস্যায় পড়েছেন। দ্বীপের হোটেল, রেস্তোরাঁ ও দোকানমালিকারা জানাচ্ছেন, নভেম্বর মাসে রাতযাপনের সুযোগ না দেওয়ায় ব্যবসায় ক্ষতি হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো. জমির উদ্দিন জানিয়েছেন, দ্বীপে পানীয় জলের সংকট নিরসন, বেওয়ারিশ কুকুরের প্রজনন ঠেকানো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন, বনায়ন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ একাধিক প্রকল্পের কাজ চলছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এসব প্রকল্প শেষ হলে দ্বীপবাসীর জীবিকা ও পরিবেশের সংকট দূর হবে।
দ্বীপে পানীয় জলের সংকট নিরসন, বেওয়ারিশ কুকুরের প্রজনন ঠেকাতে বন্ধ্যাকরণ প্রকল্প, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য থেকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন, বনায়ন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, নতুন জেটি নির্মাণসহ শত কোটি টাকার একাধিক প্রকল্পের কাজ চলছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দ্বীপের মানুষের সংকট দূর হবে।
মো. জমির উদ্দিন, পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক
সেন্ট মার্টিনে পর্যটক সীমিত করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ফলে আগে টেকনাফ থেকে চলত পর্যটকবাহী জাহাজ এখন কক্সবাজার শহর থেকে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে চলাচল করবে।

