সংবিধান সংস্কারের অংশ হিসেবে গণভোট আয়োজনের সুপারিশ দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধানসংক্রান্ত সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে সরকার বিশেষ আদেশ জারি করবে এবং গণভোটের মাধ্যমে তা অনুমোদিত হবে।
গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে পরবর্তী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংশোধন কার্য সম্পন্ন করবে। তবে গণভোটের তারিখ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সরকার চাইলে জাতীয় নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট আয়োজন করতে পারবে।
স্বাধীন বাংলাদেশে তিনটি গণভোট-
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ছিল প্রশাসনিক গণভোট এবং একটি সাংবিধানিক। প্রথমটি হয়েছিল ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে, দ্বিতীয়টি ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে এবং তৃতীয়টি ১৯৯১ সালে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে।
১৯৭৭: জিয়াউর রহমানের গণভোট-
১৯৭৭ সালের ৩০ মে দেশে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। উদ্দেশ্য ছিল সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়া জিয়াউর রহমানের শাসনের বৈধতা যাচাই করা। ওই বছরের ২২ এপ্রিল তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে গণভোটের ঘোষণা দেন। সারাদেশে ২১ হাজার ৬৮৫টি কেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ হয়।
তখন দেশের ভোটার সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৮৪ লাখ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, মোট ভোট পড়েছিল ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ‘না’ ভোট ১ দশমিক ১ শতাংশ।
১৯৮৫: এরশাদের শাসন যাচাই-
দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ। তখন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এরশাদের নীতি ও কর্মসূচির প্রতি জনগণের আস্থা যাচাইয়ের লক্ষ্যে এই ভোট আয়োজন করা হয়। ভোটগ্রহণ হয় আগের মতোই ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ পদ্ধতিতে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে, ওই গণভোটে ভোট পড়েছিল ৭২ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট ছিল ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ‘না’ ভোট ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
১৯৯১: সংসদীয় পদ্ধতিতে ফেরার গণভোট-
১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলনে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যেখানে বিজয়ী হয় বিএনপি। এর পর ১৬ বছরের রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের জন্য ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে দ্বাদশ সংশোধনী বিল সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়।
পরবর্তীতে ১৫ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী গণভোট অনুষ্ঠিত হয় সংসদীয় সরকারব্যবস্থা অনুমোদনের জন্য। সেখানে ভোট পড়েছিল ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট ছিল ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং ‘না’ ভোট ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। বৈধ ভোটের হার ছিল ৯৯ দশমিক ১৩ শতাংশ, আর বাতিল ভোট মাত্র শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও নতুন প্রস্তাবিত গণভোট-
রাষ্ট্র সংস্কারবিষয়ক জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ সালের ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়। এনসিপি ছাড়া জুলাই আন্দোলনের পক্ষে থাকা প্রায় সব দলই এতে স্বাক্ষর করে। পরে ঐকমত্য কমিশন সনদের ৮৫ দফা বাস্তবায়নে সুপারিশ জমা দেয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে। এর মধ্যে ৯টি বাস্তবায়নের প্রস্তাব নির্বাহী আদেশে, ২৮টি আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের মাধ্যমে এবং সংবিধান সম্পর্কিত ৪৮টি প্রস্তাব বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প উপায় সুপারিশ করা হয়।
সনদে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ কয়েকটি দলের নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে তা রাখা হয়নি। সূত্রমতে, সংবিধানসংক্রান্ত ২৬টি প্রস্তাবে বিভিন্ন দলের আপত্তি রয়েছে। বিএনপির আপত্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে—উচ্চকক্ষে পিআর ব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান একই না থাকা, গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে স্পিকারের মাধ্যমে নিয়োগ এবং সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের সমর্থন বাধ্যতামূলক করা।
কমিশনের প্রতিবেদনে গণভোটের সুপারিশ থাকলেও তার সময় নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের হাতে। বিএনপি চাইছে জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট, আর জামায়াত ও এনসিপি চাইছে নির্বাচনের আগে। জামায়াতে ইসলামী নভেম্বর মাসে গণভোটের দাবিতে ইতিমধ্যেই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

