২০২৪ সালের শিক্ষার্থী নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের পর আবারো সুন্দরবনে ফিরে এসেছে জলদস্যু চক্রগুলো। এদের অধিকাংশই পূর্বে আত্মসমর্পণ করা দস্যু, পলাতক আসামি বা জেল পালানো অপরাধী। সরকারি তথ্যমতে, বর্তমানে অন্তত নয়টি জলদস্যু গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, তবে বেসরকারি অনুমান বলছে সংখ্যা পনেরো থেকে বিশটির মধ্যে।
এই দলগুলো সংগঠিতভাবে চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। জেলেদের কাছ থেকে আগাম ‘নিরাপত্তা খরচ’ আদায় করা হচ্ছে। যারা টাকা দেয়, তাদের বনাঞ্চলে মাছ ধরতে দেওয়া হয়, আর যারা দেয় না, তাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। মুক্তিপণের পরিমাণ সাধারণত ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত।
গত ১ সেপ্টেম্বর বন খুলে দেওয়ার পর থেকে জেলেদের অপহরণ ও মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়ার ঘটনা বেড়েছে। তবে অধিকাংশ ভুক্তভোগী প্রতিশোধের ভয়ে অভিযোগ করতে সাহস পান না, ফলে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা অজানা রয়ে গেছে।
২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সুন্দরবনে সক্রিয় ৩২টি জলদস্যু গোষ্ঠীর ৩২৮ সদস্য আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তারা জমা দেন ৪৬২টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২২ হাজার ৫০৪ রাউন্ড গুলি। এরপর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সরকার সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করে।
কোস্ট গার্ডের দাবি: পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে-
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের পশ্চিমাঞ্চলীয় জোন জানিয়েছে, ৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া অভিযানে তারা ৪৫ জন জলদস্যু ও সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং ৪৮ জন অপহৃত জেলেকে উদ্ধার করেছে। সংস্থাটি দাবি করেছে, এসব অভিযানের ফলে দস্যু কার্যক্রমে বড় ধরনের ভাটা পড়েছে।
কোস্ট গার্ডের গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সক্রিয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে—মো. করিম শরীফের নেতৃত্বাধীন করিম শরীফ বাহিনী, জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বাধীন জাহাঙ্গীর বাহিনী, আলিফ মোল্লা দয়ালের নেতৃত্বে দয়াল বাহিনী, রোবিউল ইসলামের নেতৃত্বে দুলাভাই বাহিনী, সুমনের নেতৃত্বে ছোট সুমন বাহিনী, হান্নান বাহিনী, রাঙ্গা বাহিনী ও ছোটন বাহিনী।
এক বিবৃতিতে কোস্ট গার্ড জানায়, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বড় ধরনের কোনো সক্রিয় দস্যু গোষ্ঠী এখন আর নেই, যদিও কয়েকটি ছোট দল পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে।
কোস্ট গার্ড কর্মকর্তারা জানান, দস্যুরা নিয়মিত অবস্থান পরিবর্তন করছে। বনাঞ্চলের ভেতরে অভিযানে একাধিক আস্তানা ধ্বংস করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের ভাষায়, “আমরা বনভূমির গভীরে অভিযান চালিয়ে তাদের অনেকটাই কোণঠাসা করেছি। শিগগিরই সুন্দরবন আবার দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা যাবে।”
তাদের কাছে থাকা অস্ত্র সাধারণত দেশি তৈরি—একনলা ও দু’নলা বন্দুক, এয়ারগান, শটগান এবং ধারালো অস্ত্র যেমন দা ও ছুরি। এগুলো ব্যবহার করেই তারা জেলেদের ভয় দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে এবং নদীপথে ডাকাতি চালায়।
নীরব ভুক্তভোগী এবং প্রশাসনের তৎপরতা-
খুলনার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, “নৌবাহিনী নিয়মিত টহল দিচ্ছে, কোস্ট গার্ড সতর্ক আছে, নদী পুলিশও যুক্ত রয়েছে। বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এবং অভিযান অব্যাহত আছে।”
তিনি স্বীকার করেন যে জলদস্যু কার্যক্রমের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে। “হ্যাঁ, এমন অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে এবং আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি,” বলেন তিনি।
বাগেরহাটের সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, সেপ্টেম্বর থেকে তিনটি বড় গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে—শরীফ বাহিনী, জাহাঙ্গীর বাহিনী ও আসাদ বাহিনী। তিনি বলেন, “১ সেপ্টেম্বর বন খোলার পর জেলেরা প্রবেশ শুরু করে। তখন থেকেই কয়েকজন অপহৃত হয়েছেন, মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। যদিও সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই।”
রেজাউল করিম জানান, ভয়ে জেলেরা সাধারণত এসব ঘটনা নিজেরাই মীমাংসা করেন। “তারা সাধারণ ডায়েরি করে না, আমাদেরও জানায় না। কারণ, তাদের আবারও বনে ফিরতে হয়,” বলেন তিনি।
চাঁদাবাজির কৌশল-
সৈকত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে রিপোর্ট করা সাংবাদিক মোহসিন উল হাকিম জানান, বর্তমানে অন্তত ছয় থেকে সাতটি দস্যু গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। “তারা মূলত জেলেদের কাছ থেকে আগাম চাঁদা নেয়। যারা টাকা দেয়, তারা নির্বিঘ্নে মাছ ধরতে পারে। কিন্তু কেউ যদি টাকা না দেয়, তাকে অপহরণ করে ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়,” বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে জলদস্যুদের স্থলে দেখা যাওয়ার খবর অস্বাভাবিক। সাধারণত সুন্দরবনের দস্যুরা স্থলে আসে না। যদি কোনো দল স্থলে দেখা যায়, তারা সম্ভবত পলাতক অপরাধী, নিয়মিত বনভিত্তিক নয়।”
কোস্ট গার্ডের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন-
তবে কোস্ট গার্ডের অভিযানের কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন একাধিক সূত্র। এক গোপন সূত্র জানায়, “কোস্ট গার্ডের ভূমিকা নিয়ে আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। তাদের কর্মকাণ্ড অনেক সময় সন্দেহজনক মনে হয়। অনেক অভিযান আসলে দেখানোর জন্য।”
অন্য এক সূত্র অভিযোগ করেন, “জাহাঙ্গীর নামের এক জলদস্যু জেলেদের অপহরণ করে। মুক্তিপণ দেওয়ার পর কোস্ট গার্ড গিয়ে তাদের উদ্ধার করে এবং নিজেদের কৃতিত্ব দাবি করে।”
যদিও এমন অভিযোগ রয়েছে, কর্তৃপক্ষ বলছে জলদস্যু দমন অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, নদী পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে যৌথভাবে সুন্দরবনকে আবারও দস্যুমুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে।
অতীতের অভিজ্ঞতা এবং নতুন বাস্তবতা-
২০১৮ সালে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সুন্দরবন কিছুদিনের জন্য নিরাপদ হয়েছিল। স্থানীয় জনগণ, জেলে ও বনজীবীরা তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক শিথিলতার সুযোগে পুরনো দস্যুরা পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা নদীপথে পুরনো যোগাযোগ পুনর্গঠন করে দ্রুত সংগঠিত হতে পেরেছে।
বর্তমানে সুন্দরবনের গভীর অরণ্যে ও নদী-খালে এসব গোষ্ঠীর আস্তানা গড়ে উঠেছে। মাছ ধরার নৌকা, কাঠবোঝাই ট্রলার বা মধু সংগ্রহকারীদের লক্ষ্য করে তারা হামলা চালায়। প্রতিটি গোষ্ঠী নির্দিষ্ট এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে, যেন তাদের ‘সীমানা’ নির্ধারিত থাকে। এতে স্থানীয় জেলেরা বাধ্য হয়ে মাসে মাসে চাঁদা দেয়, না হলে তাদের জীবিকা ঝুঁকির মুখে পড়ে।
দস্যু দমনে করণীয়-
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের জলদস্যু দমন শুধুমাত্র অভিযান দিয়ে সম্ভব নয়। দরকার টেকসই অর্থনৈতিক পুনর্বাসন, বিকল্প জীবিকার সুযোগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে জনগণের আস্থা পুনর্গঠন।
সুন্দরবন অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কিছু অসাধু ব্যক্তির যোগসাজশের অভিযোগও রয়েছে। ফলে নিয়মিত টহল ও তদারকির পাশাপাশি জবাবদিহি ব্যবস্থাও জোরদার করতে হবে বলে মনে করেন স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা।
তারা বলেন, সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য, যার নিরাপত্তা শুধু অর্থনৈতিক নয়, পরিবেশগত দিক থেকেও জরুরি। যদি জলদস্যুরা আবার সেখানে আধিপত্য বিস্তার করে, তবে বনাঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র, বন্যপ্রাণী এবং উপকূলীয় অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, সমন্বিত অভিযান অব্যাহত থাকবে যতদিন না পর্যন্ত সুন্দরবন সম্পূর্ণ নিরাপদ ঘোষণা করা যায়। তবে স্থানীয় জনগণ মনে করে, দস্যুদের পুনরুত্থান প্রমাণ করে যে আগের আত্মসমর্পণ কার্যক্রম যথেষ্ট ছিল না। স্থায়ী সমাধানের জন্য দরকার স্বচ্ছ প্রশাসন, জবাবদিহি ও বিকল্প উন্নয়ন পরিকল্পনা—যাতে সুন্দরবনের মানুষ আর কখনো জলদস্যুতার দিকে না ফিরে যায়।

