বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির পুঁতে রাখা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে আহত হয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এক সদস্য মারা গেছেন। সীমান্ত এলাকায় এই মৃত্যুর ঘটনা আবারো প্রমাণ করেছে যে, পাহাড়ি অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে, যা সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং বেসামরিক নাগরিক উভয়ের জন্যই উদ্বেগের বিষয়।
নিহত নায়েক মো. আখতার হোসেন (৩৫) কক্সবাজারের ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলেন। গত ১২ অক্টোবর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে টহল দেওয়ার সময় শূন্যরেখার কাছে মাইন বিস্ফোরণে তার ডান পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাঁকে প্রথমে রামু সেনানিবাস হাসপাতালে এবং পরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয়, যেখানে শুক্রবার তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বিজিবি কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের ডিসেম্বরে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী সীমান্ত অঞ্চল থেকে সরে যাওয়ার পর বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) ওই এলাকা দখল করে। তখন থেকেই তারা সীমান্তজুড়ে এমনকি নো-ম্যানস ল্যান্ডেও মাইন পুঁতে রাখছে বলে জানা গেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও মিয়ানমারের সিতওয়েতে নিযুক্ত সাবেক কনসাল জেনারেল মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, “সীমান্তে নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা ও যেকোনো উসকানি এড়াতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।” তাঁর মতে, আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে নির্বিচারে ল্যান্ডমাইন পুঁতে রেখেছে, যা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন।
তিনি আরো বলেন, “বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সীমান্ত এলাকায় মাইন অপসারণ অভিযান পরিচালনা করা এখন সময়ের দাবি।”
বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও আরাকান আর্মির সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৬৫ জন বাংলাদেশি ল্যান্ডমাইনে আহত হয়েছেন। এছাড়া ২০২৪ সালে দুই রোহিঙ্গা নিহত ও ২০২৩ সালে পাঁচজন আহত হয়েছেন।
বিজিবির রামু সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “বিজিবি সদস্য শূন্যরেখায় দায়িত্ব পালনের সময় আহত হন। ওই এলাকায় কোনো মাইন থাকার কথা নয়, কিন্তু আরাকান আর্মি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সেখানে মাইন স্থাপন করেছে।” তিনি জানান, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মিকে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে, যদিও এখনো কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা এড়াতে মাইন অপসারণ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
বিজিবি সদর দপ্তর জানিয়েছে, শনিবার ভোলার নিজ গ্রামে পূর্ণ সামরিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আখতার হোসেনকে দাফন করা হয়। এক বিবৃতিতে বিজিবি জানায়, “দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তাঁর সর্বোচ্চ ত্যাগ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, নাইক্ষ্যংছড়ির দুছড়ি থেকে টেকনাফের হোয়াইক্যং পর্যন্ত সীমান্তজুড়ে এখন প্রায় নিয়মিত সংঘর্ষ হচ্ছে আরাকান আর্মি, রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠন আরসা, আরএসও ও আরার মধ্যে। গত ২৫ অক্টোবর হোয়াইক্যং এলাকায় সীমান্তের ওপার থেকে আসা গুলিতে চেনোয়ারা বেগম নামের এক বাংলাদেশি নারী আহত হন।
ইউপি সদস্য সিরাজুল মোস্তফা বলেন, “নাফ নদীর তীরে চিংড়ি ঘের বা কাঁকড়া ধরার কাজ যারা করেন, তারা এখন ভয় পাচ্ছেন। কেউ আর সহজে নদীতে নামছেন না।”
কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, এসব সংঘর্ষ মিয়ানমারের ভেতরে ঘটছে। তবে যাতে কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়ে স্থানীয়দের সতর্ক করা হয়েছে এবং টহল জোরদার করা হয়েছে।
অন্যদিকে, সীমান্তে বঙ্গোপসাগর থেকে জেলেদের অপহরণের ঘটনাও বেড়েছে। সরকারি তথ্যমতে, গত আগস্ট থেকে আরাকান আর্মি অন্তত ১১৬ জন বাংলাদেশি জেলেকে অপহরণ করেছে। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ২৩৫ জন জেলে অপহৃত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ১২৪ জন ফিরলেও এখনো ১১১ জন বন্দী, যাদের মধ্যে ৬২ জন রোহিঙ্গা।
টেকনাফ কউকখালী ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি সাজিদ আহমেদ বলেন, “জেলেরা এখন সাগরে যেতে ভয় পাচ্ছেন।”
টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন জানান, অভিযোগ অনুযায়ী এখনো ১০৬ জন জেলে বন্দী আছেন। তিনি বলেন, “আরাকান আর্মির সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ না থাকায় অনানুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের ফেরানোর চেষ্টা চলছে।”

