জনপ্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব— এই দুই শীর্ষ পদ ছাড়াও ১১ জন সিনিয়র সচিবের মধ্যে ১০ জনই বর্তমানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কর্মরত রয়েছেন।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিনিয়র সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের এত আধিক্য যৌক্তিক নয়।
চুক্তিতে আছেন যারা-
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ ও প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন— জনপ্রশাসনের এই শীর্ষ দুই কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কর্মরত রয়েছেন।
অন্যদিকে, ১১ জন সিনিয়র সচিবের মধ্যে ১০ জনেরই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। তারা হলেন— জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. নেয়ামত উল্লাহ ভূইয়া, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ. এস. এম. সালেহ আহমেদ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য পদেও দুইজন সিনিয়র সচিব কর্মরত রয়েছেন। তারা হলেন- মো. মোখলেস উর রহমান ও এম এ আকমল হোসেন আজাদ।
এছাড়া, জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমি (এনএপিডি)-এর মহাপরিচালক (সিনিয়র সচিব) সিদ্দিক জোবায়েরও চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োজিত।
জনপ্রশাসনের মৌলিক কাঠামোতে প্রকৃতপক্ষে ‘সিনিয়র সচিব’ নামের কোনো পদ নেই। সিনিয়র সচিব ও সচিবের কাজ একই। তবে, বেতন ও পেনশনসহ নানা ক্ষেত্রে সিনিয়র সচিব পদের আর্থিক সুবিধা বেশি। এজন্য মূলত পছন্দের আমলাদের খুশি করতে এ পদের সৃষ্টি করা হয় বলে সমালোচনা রয়েছে।
সিনিয়র সচিব পদে নিয়মিতদের মধ্যে শুধুমাত্র পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোকাব্বির হোসেন কর্মরত আছেন। এ বিষয়ে জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. এহসানুল হককে একাধিকবার ফোন দিলেও ধরেননি তিনি। মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে লিখিত বক্তব্য চাইলেও পাওয়া যায়নি।
‘এটা কখনোই যৌক্তিক হতে পারে না’-
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘১৩ জনের মধ্যে ১২ জনই চুক্তিভিত্তিক— এটা কখনোই যৌক্তিক হতে পারে না। কিন্তু যারা এসব নিয়োগ দেন, তারা তো কোনো যৌক্তিকতার ধার ধারেন না।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভুইঞা বলেন, ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে আগে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের একটা নিয়ম ছিল। এখন সেটা অনুসরণ করা হয় কি না, জানা নেই।’
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ-
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে অসন্তোষ রয়েছে। সচিবালয়ে অবস্থিত একটি মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘কোনো পদ খালি হলে নতুন কেউ সেই দায়িত্ব নেবেন, এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে সেই কর্মকর্তা বঞ্চিত হন।’
সচিব ও সম-পদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা ৬০ জন করার সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সংখ্যা এখনকার মতো একজনই রাখতে বলা হয়েছে। তবে, মুখ্য সচিবের পদ ১৭টি করতে বলা হয়েছে। একাধিক বিভাগ থাকা মন্ত্রণালয়ে মুখ্য সচিব থাকবেন
যেভাবে সৃষ্টি হয় সিনিয়র সচিবের পদ-
সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করা হয় ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এ পদ সৃষ্টি করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে অনুগত আমলাদের এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
জনপ্রশাসনের মৌলিক কাঠামোতে প্রকৃতপক্ষে ‘সিনিয়র সচিব’ নামের কোনো পদ নেই। সিনিয়র সচিব ও সচিবের কাজ একই। তবে, বেতন ও পেনশনসহ নানা ক্ষেত্রে সিনিয়র সচিব পদের আর্থিক সুবিধা বেশি। এজন্য মূলত পছন্দের আমলাদের খুশি করতে এ পদের সৃষ্টি করা হয় বলে সমালোচনা রয়েছে।
সিনিয়র সচিব পদ বাদ দিতে সুপারিশ-
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ‘সিনিয়র সচিব’ পদ বাদ দিতে সুপারিশ করেছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেন কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করা হয়।
১৩ জনের মধ্যে ১২ জনই চুক্তিভিত্তিক— এটা কখনোই যৌক্তিক হতে পারে না। কিন্তু যারা এসব নিয়োগ দেন, তারা তো কোনো যৌক্তিকতার ধার ধারেন না।
মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া, জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ
কমিশন সচিব ও সম-পদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা ৬০ জন করার সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সংখ্যা এখনকার মতো একজনই রাখতে বলা হয়েছে। তবে, মুখ্য সচিবের পদ ১৭টি করতে বলা হয়েছে। একাধিক বিভাগ থাকা মন্ত্রণালয়ে মুখ্য সচিব থাকবেন।
বর্তমানে মুখ্য সচিবের একটি পদ রয়েছে। এ বিষয়ে কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়গুলো পুনর্বিন্যস্ত করা হলে একাধিক বিভাগ সৃষ্টি হবে। যেসব মন্ত্রণালয়ে একাধিক বিভাগ থাকবে, সেগুলোতে সচিবের পাশাপাশি একজন মুখ্য সচিব নিয়োগ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বর্তমান সিনিয়র সচিব পদ বাদ দিতে বলেছে কমিশন।
সূত্র: ঢাকা পোস্ট

