বাংলাদেশের আকাশপথে নতুন যুগের সূচনা ঘটাতে যাচ্ছে সরকার। এবার বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোকেও দেশে নিজস্ব অফিস খুলে সরাসরি ব্যবসা পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হবে। এতদিন পর্যন্ত তারা শতভাগ বাংলাদেশি মালিকানাধীন কোনো এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট বিক্রি ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করত।
এই বড় পরিবর্তনটি আনতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় তৈরি করেছে ‘বেসামরিক বিমান চলাচল (সংশোধন) অধ্যাদেশ–২০২৫’ নামে একটি খসড়া আইন, যা বর্তমানে মতামতের জন্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
খসড়া অনুযায়ী, কোনো বিদেশি এয়ারলাইন চাইলে নিজস্ব অফিস খুলে সরাসরি কার্যক্রম চালাতে পারবে। আবার চাইলে আগের মতোই শতভাগ বাংলাদেশি মালিকানাধীন এক বা একাধিক সংস্থাকে ‘জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ)’ হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে।
বর্তমান বেসামরিক বিমান চলাচল আইন–২০১৭ অনুযায়ী, বিদেশি এয়ার অপারেটররা বাংলাদেশে নিজেদের অফিস খুলতে পারে না। ফলে তাদের কার্যক্রম পুরোপুরি নির্ভর করে জিএসএদের ওপর।
মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নতুন আইনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হচ্ছে যাতে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ে, টিকিট বিক্রিতে স্বচ্ছতা আসে এবং যাত্রীদের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়। এজন্য ৪টি ধারা পরিবর্তন ও নতুন করে ১৭টি উপধারা যুক্ত করা হচ্ছে।
বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম মনে করেন, “একসময় বিদেশি এয়ারলাইনগুলো বাংলাদেশে সরাসরি অফিস খুলে ব্যবসা করতে পারত। পরে সরকার সেই সুযোগ বন্ধ করে দেয় স্থানীয় বাজার রক্ষার জন্য। এখন সরকার বুঝতে পারছে, যাত্রীদের জন্য টিকিটের দাম সহনীয় রাখতে হলে প্রতিযোগিতা বাড়ানো দরকার।”
তার মতে, “কিছু জিএসএ নিজেদের মধ্যে আঁতাত করে টিকিটের দাম বাড়াচ্ছে—এটা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।”
অন্যদিকে, জিএসএ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন আইনের বিরোধিতা করছে। তারা বলছে, এই বিধান বাতিল হলে তাদের হাজারো কর্মীর জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত এক মানববন্ধনে তারা জিএসএ বাধ্যতামূলক রাখার দাবি জানিয়েছেন।
নতুন খসড়ায় টিকিট বিক্রিতে অনিয়ম রোধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোনো ট্রাভেল এজেন্সি যাত্রীর কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়ার বেশি টাকা নিলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং অতিরিক্ত আদায়ের তিনগুণ অর্থ ফেরত দিতে হবে।
এছাড়া, টিকিট মজুত রেখে সংকট তৈরি করা বা কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ালে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর জেল বা ৫০ লাখ টাকা জরিমানা, কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
একই সঙ্গে, কোনো রুটে অস্বাভাবিক ভাড়া দেখা দিলে বেবিচক চেয়ারম্যান নিজেই যুক্তিসঙ্গত টিকিটমূল্য নির্ধারণ করতে পারবেন।
বেসামরিক বিমান পরিবহন উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন সম্প্রতি বলেছেন, “কিছু অসাধু ব্যবসায়ী টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছিল। এখন সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে।”
খসড়া আইনে গ্রাউন্ড অপারেটর, গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (জিডিএস) প্রতিষ্ঠান এবং ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এখন থেকে বাংলাদেশে কার্যক্রম চালাতে হলে এসব প্রতিষ্ঠানকে বেবিচকের অনুমোদন নিতে হবে। চেয়ারম্যান চাইলে জিডিএস সিস্টেমে রিয়েল-টাইম প্রবেশাধিকার পাবেন, যাতে তিনি টিকিট বুকিং ও মূল্য সংক্রান্ত তথ্য সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
অবশ্য কোনো প্রতিষ্ঠান জনস্বার্থবিরোধী কাজ করলে তার নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিলের ক্ষমতাও থাকবে চেয়ারম্যানের হাতে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বিমান পরিবহন খাতে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা বাড়বে, যাত্রীদের জন্যও টিকিটের দাম কিছুটা কমে আসতে পারে।

