দেশে এখন চারপাশে একটাই আলোচনা—আসছে জাতীয় নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো যেন হঠাৎ করেই নির্বাচনের সুরে তাল মেলাতে শুরু করেছে। জুলাই সনদ, গণভোট কিংবা সংবিধান সংশোধন নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও—সবকিছুর মাঝেই রাজনীতি এখন ভোটমুখী। নির্বাচন কমিশনও শেষ প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, কারণ সরকারের ঘোষণামতো আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
কয়েক সপ্তাহ আগেও জুলাই সনদ ও গণভোট নিয়ে দলগুলোর মধ্যে তীব্র বিরোধ ছিল। অনেকে নির্বাচনের সময় ও ধরন নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার মধ্যস্থতায় পরিস্থিতির মোড় ঘুরেছে। প্রধান দলগুলো এখন মাঠে নেমে পড়েছে নির্বাচনী তৎপরতায়।
বিএনপি ইতোমধ্যে ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে, যা আপাতত ‘সম্ভাব্য তালিকা’ হিসেবে ধরা হচ্ছে। তফসিল ঘোষণার পর চূড়ান্ত তালিকায় কিছু অদলবদল হতে পারে। জামায়াতে ইসলামীও প্রার্থী বাছাই শেষ করে শিগগিরই তালিকা চূড়ান্ত করবে বলে জানিয়েছে।
এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টিও ঘোষণা দিয়েছে—তারা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, ১৫ নভেম্বরের মধ্যেই প্রকাশ পাবে তাদের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা।
অন্যদিকে গণঅধিকার পরিষদ ৫০ আসনে একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে। গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি দল মিলে ১৩৮ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। গণসংহতি আন্দোলন ঘোষণা করেছে ৯১ আসনের প্রার্থী, এবি পার্টি ১০৯, খেলাফত মজলিস ২৫৬, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ২৬৮ এবং ইসলামী আন্দোলন প্রায় ৩০০ আসনে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে।
এইসব ঘোষণা ও প্রচারণার ফলে এখন দেশের রাজনীতি যেন আবারো ভোটকেন্দ্রিক ছন্দে ফিরেছে। শহর থেকে গ্রাম—সবখানেই ভোটের আলাপ, প্রার্থীর প্রচারণা ও গণসংযোগে ভরপুর পরিবেশ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “আমাদের প্রার্থী ঘোষণার পর দেশের মানুষ পুরোপুরি নির্বাচনী ট্রেনে উঠেছে। ফেব্রুয়ারিতে এই ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছাবে, আর কোনো সংশয় নেই।”
তিনি আরও বলেন, “জুলাই সনদ নিয়ে যতটা ঐকমত্য হয়েছে, তার ভিত্তিতেই নির্বাচন হবে। ১৮ বছর পর জনগণ অবশেষে ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচনের অপেক্ষায়।”
গণভোটের দাবিতে অনড় থাকলেও, পিআর বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির দাবিতে এখন কিছুটা নমনীয় হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমির শফিকুর রহমান সিলেটে বলেন, “আমরা সবাইকে নিয়েই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে চাই। দেরি হলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। আমাদের দাবি জনগণ বিবেচনা করবে, আমরা জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণ করব না।”
নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসারের সঙ্গে বৈঠক করেছে। ইসি সচিব জানিয়েছেন, নির্বাচনের সময় ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ সেনাসদস্য, দেড় লাখ পুলিশ ও সাড়ে পাঁচ লাখ আনসার সদস্য দায়িত্বে থাকবেন।
আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইনুর রহমান বলেন, “দেশের জনগণ যেমন চায়, সেনাবাহিনীও চায় অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। এতে দেশের স্থিতিশীলতা আরও মজবুত হবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এখন দেশের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, “রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের বিকল্প নেই। এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের প্রস্তুতি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।”
সব মিলিয়ে, দীর্ঘ অনিশ্চয়তার পর দেশের রাজনীতি আবার ভোটকেন্দ্রিক পথে ফিরছে। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঘিরে তৈরি হওয়া এই নির্বাচনী আমেজ—রাজনীতির নতুন অধ্যায় সূচনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

