সরকারি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিবসহ অন্তত ২০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের দায়িত্ব বর্তমানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের হাতে রয়েছে।
প্রশাসনের পদোন্নতি সুপারিশকারী সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)-এর সাত সদস্যের মধ্যে অন্তত চারজনই চুক্তিভিত্তিক। ফলে নিয়মিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি এবং প্রশাসনের ‘লাগাম’ এখন চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তাদের হাতে।
চুক্তিভিত্তিক সচিবদের মধ্যে অন্তত ১০ জন এমন কর্মকর্তা, যাঁরা নিয়োগের আগে প্রায় এক দশক প্রশাসনিক কাজে সরাসরি নিয়োজিত ছিলেন না। ফলে প্রশাসনের সাধারণ নিয়ম ও কাঠামো মেনে চলতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। নিয়মিত কর্মকর্তারা অভিযোগ করছেন, চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তারা প্রশাসনের কাঙ্ক্ষিত মান বজায় রাখতে পারছেন না এবং শৃঙ্খলাভঙ্গ সৃষ্টি করছেন।
গত পাঁচ মাসে অন্তত ২৪ জন গ্রেড-১ ও অতিরিক্ত সচিব পদে থাকা কর্মকর্তাকে অবসরে যেতে হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রশাসনের শৃঙ্খলাবদ্ধ কাজকর্মে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, “চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকে দীর্ঘদিন নানাভাবে বঞ্চিত ছিলেন। তবে যারা প্রশাসনের দায়িত্ব পালনে যথাযথ সক্ষমতা দেখাতে পারছেন না, তাদের চুক্তি বাতিল করা উচিত। চুক্তি কারণে নিয়মিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ব্যাহত হচ্ছে এবং এতে অসন্তোষ স্বাভাবিক।”
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ সচিবদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামের মধ্যে রয়েছেন— মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এহসানুল হক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. মো. মোখলেস উর রহমান, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া, জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক (সিনিয়র সচিব) সিদ্দিক জোবায়ের, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী সহ আরো অনেকে।
এছাড়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফকে বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। পাশাপাশি ড. মাহফুজুল হককে পর্তুগালে রাষ্ট্রদূত এবং বেগম শরিফা খানকে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে প্রশাসনে নিয়মিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ব্যাহত হচ্ছে। একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, দীর্ঘ সময় প্রশাসনের বাইরে থাকায় চুক্তিভিত্তিক সচিবরা প্রশাসনের দায়িত্ব পালনে যথাযথ দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারছেন না। তাদের মধ্যে অনেকে প্রশাসনের পুরনো নিয়ম-কানুন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছেন এবং নিজের ব্যাচমেটদের নিয়ে একটি বলয় তৈরি করেছেন। এতে অন্যান্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারছেন না।
ফলে মাঠ প্রশাসনে ডিসি নিয়োগেও জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ডিসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বার্থপর লেনদেনের ঘটনা ঘটছে। এমনকি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ডিসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন, কখনও এক ঘণ্টা ওয়াশরুমে আটকানোর মতো ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে।
শিক্ষাসচিব ও জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগেও রাজনৈতিক প্রভাব প্রকাশ পেয়েছে। চুক্তিভিত্তিক সচিবরা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখার চেষ্টা করছেন। ডিসি নিয়োগ ও প্রশাসন পরিচালনায় রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থের লড়াই দেখা যাচ্ছে। ফলে প্রশাসনে অস্থিরতা ও শৃঙ্খলাভঙ্গ সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে আস্থা কমে যাওয়ায় প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পদগুলোতে প্রশাসনের মূল নিয়ন্ত্রণ এখন চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তাদের হাতে।

