বাংলাদেশের সড়কে গত এক বছরে ভয়াবহ প্রাণহানির চিত্র উঠে এসেছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ৪২০ জন এবং আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৫২৮ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে দেশের রাস্তায়।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো— নিহতদের ৪৮ শতাংশই নারী, শিশু ও পথচারী—যারা সমাজের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশ। নিহতদের মধ্যে নারী ৯০৮ জন, শিশু ৮৭১ জন এবং পথচারী ১ হাজার ৩২২ জন। এছাড়া চালক ও সহকারীর সংখ্যা ৮৫৫ জন। এই চার শ্রেণির মৃত্যু মিলিয়ে মোট নিহতের ৬১ দশমিক ৬২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পরিসংখ্যান প্রমাণ করে সড়ক নিরাপত্তা কাঠামো এখনো সমাজের দুর্বল অংশকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ। দেশের সড়ক দুর্ঘটনা এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং এটি একটি ভয়াবহ জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে।
মোটরসাইকেল—সড়কের প্রধান ঘাতক-
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, একক বাহন হিসেবে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেল সংশ্লিষ্ট ঘটনায়। গত ১২ মাসে মোট ২ হাজার ৬৯৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৪৪৮ জন নিহত হয়েছেন—যা মোট মৃত্যুর ৩৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ, সড়কে প্রতি পাঁচজন নিহতের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হচ্ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়।
ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, তরুণ ও যুবকদের বেপরোয়া চালনা, নিরাপত্তা হেলমেট ব্যবহার না করা এবং নিয়ন্ত্রণহীন গতি এই মৃত্যুহারের পেছনের মূল কারণ।
কোথায় বেশি দুর্ঘটনা-
দুর্ঘটনার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ঘটছে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে, যেখানে যানবাহনের চাপ, অব্যবস্থাপনা এবং ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। দেশের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হওয়ায় এখানেই সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি সবচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগেও দুর্ঘটনার হার ক্রমবর্ধমান। ফাউন্ডেশন জানায়, অতিরিক্ত গতি, স্বল্পগতির যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক নকশা এবং ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ—এসবই এই মৃত্যুফাঁদে অবদান রাখছে।
দুর্ঘটনার মূল কারণ
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, অতিরিক্ত গতি ও চালকের নিয়ন্ত্রণ হারানো—এ দুটি কারণেই ঘটে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ দুর্ঘটনা। এ ছাড়া অদক্ষ চালক, মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি এবং যানবাহনের ত্রুটিও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে শুধু ব্যক্তিগত বেপরোয়া আচরণ নয়, বরং সমন্বয়হীন পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও দুর্বল আইন প্রয়োগের বড় ভূমিকা আছে।
বিশেষজ্ঞদের মত-
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল হক বলেন, “মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু ক্রমেই বাড়ছে। এই যানের জন্য সড়কে আলাদা লেন তৈরি করতে হবে, নইলে ঝুঁকি কমানো সম্ভব নয়। পাশাপাশি পথচারীদের জন্য আলাদা জায়গা রাখতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “শহরে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও শহরের বাইরে মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা বাজারগুলোও দুর্ঘটনার বড় কারণ। এসব বাজার ও অবৈধ পারাপার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।”
উপেক্ষিত সুপারিশ-
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সরকারের কাছে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ দিয়েছে, যার অনেকগুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে—
- দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি;
- চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্ধারণ;
- বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি;
- ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ;
- স্বল্পগতির যানবাহনের জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা (সার্ভিস রোড);
- মহাসড়কে বিভাজক নির্মাণ;
- গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ;
- রেল ও নৌপথ সংস্কার করে সড়কপথের ওপর চাপ কমানো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত না হলে আগামী বছরগুলোতে সড়ক মৃত্যুর হার আরো বাড়তে পারে।

