দেশে আইন নিজের হাতে নেওয়া নতুন ঘটনা নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মব বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে মানুষের জীবন-মৃত্যুর পরিসংখ্যান ভয়ংকর বাস্তবতা প্রকাশ করছে। অভিযোগ প্রমাণ বা সত্যতা যাচাই ছাড়াই সন্দেহভাজন ব্যক্তি পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে।
মাগুরার মহম্মদপুরে মো. ইসরাফিলকে মোবাইল ও টাকা চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তার ভাই মামলা করেছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। পুলিশ ঘটনা ‘জটিল’ ও ‘স্পর্শকাতর’ বললেও প্রশ্ন থাকে, হত্যার পর জটিলতার অজুহাত কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
সংবাদমাধ্যম প্রথম আলোর বিশ্লেষণ অনুসারে, গত ১৩ মাসে গণপিটুনিতে ৬৭ জন নিহত হয়েছেন। ৪৬টি ঘটনায় মামলা হলেও মাত্র ১.২৭ শতাংশ আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৯৯ শতাংশ হত্যাকারী নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা যখন ব্যর্থ, তখন নাগরিকদের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস ক্ষয় হচ্ছে।
গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের পর মব সহিংসতা বেড়েছে। ক্ষোভ ও প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিচার-বিবেচনা গ্রাস করা হলে গণপিটুনি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এই সহিংসতায় শিশু ও মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষও শিকার হচ্ছে। কিছু মানুষ এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে ‘মব জাস্টিস’ বলে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
সংবিধান ও আইন অনুযায়ী, অপরাধীরও আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার রয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা আদালতের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার ওপর ভিত্তি করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার কথা বলেছে। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল জনতা কীভাবে রাস্তায় বেআইনী প্রক্রিয়ায় ‘বিচার’ চালাচ্ছে, তা গভীর উদ্বেগের বিষয়।
পুলিশের যুক্তি হলো, গুজব বা উত্তেজনায় এসব ঘটনা ঘটে এবং জনতা ছত্রভঙ্গ হয়। তবে যখন সংবাদমাধ্যমের নজরে আসে, তখনই কেন গ্রেপ্তার কার্যক্রম শুরু হয়? রংপুরে দলিত সম্প্রদায়ের দুইজনকে হত্যার ভিডিও ভাইরাল হলে আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যান্য কম আলোচিত ঘটনার ক্ষেত্রে তদন্ত ও গ্রেপ্তার শূন্য। এর মানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘সিলেকটিভ’ কার্যক্রম চালাচ্ছে।
গণপিটুনি শুধু আইন লঙ্ঘন নয়, বরং এটি বর্বরতার চূড়ান্ত প্রকাশ। অভিযোগ প্রমাণের আগেই শাস্তি দিলে সমাজ বর্বর হয়ে যায়। রাষ্ট্রকে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে—কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আইন হাতে নেওয়ার পর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিটি গণপিটুনি মামলার অগ্রগতি কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং অভিযুক্তদের দ্রুত শনাক্তে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
অন্যায়ের বিচার না হলে অন্যায় চলতেই থাকে। শুধু মামলা নেওয়া বা কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা যথেষ্ট নয়; রাষ্ট্রকে ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসন, নিরাপত্তা, মনস্তাত্ত্বিক ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। সমাজের সচেতনতা জরুরি—গণপিটুনি ন্যায়বিচার নয়, এটি হত্যাকাণ্ড।
অন্যায় থামাতে হলে একটি মাত্র উদাহরণ যথেষ্ট—প্রতিটি মামলায় দ্রুত ও যথাযথ শাস্তি। অপরাধ করলে পার পাওয়া যাবে না—এই বার্তা দেওয়া গেলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং আইন নিজের হাতে নেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হবে।

