নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে ততই বাড়ছে অস্থিরতা। জুলাই অভ্যুত্থানের পর যে সামান্য স্থিতিশীলতা ফিরেছিল, তা আবারও ভেঙে যাচ্ছে মতবিরোধ আর কৌশলগত পাল্টা-পাল্টি অবস্থানের ভেতর দিয়ে।
একদিকে জুলাই সনদের সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অন্যদিকে ভোটের সময় এগিয়ে আসছে দ্রুত। এই জটিল সময়েই মাঠে নেমেছে জামায়াতসহ সমমনা আটটি দল, যাদের দাবি—গণভোট ছাড়া নির্বাচন নয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব আন্দোলন কি সত্যিই নির্বাচনের প্রস্তুতি, নাকি রাজনীতির মাঠকে আবার উত্তপ্ত করার ইঙ্গিত?
৩ নভেম্বর বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে ২৩৭ আসনে প্রার্থীর নাম। বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘোষণা ছিল একধরনের ‘রাজনৈতিক বার্তা’—যে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে, যদিও সব দাবি এখনো পূরণ হয়নি।
এই ঘোষণার পর বিএনপির মিত্র নয় এমন কয়েকটি দল—বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—নির্বাচনমুখী হওয়ার তাগিদ অনুভব করছে।
অন্যদিকে, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ আট দলের দাবি আরও স্পষ্ট: দ্রুত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নির্দেশ দিতে হবে, এবং নির্বাচনের আগে গণভোটের তারিখ ঘোষণা করতে হবে।
৬ নভেম্বর ঢাকার পল্টনের সমাবেশে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন—১১ নভেম্বরের পর ঢাকার চিত্র বদলে যাবে, যদি গণভোটের তারিখ ঘোষণা না হয়।
পরদিন খুলনায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারও একই সুরে বলেন, ভোটের আগে গণভোট না হলে দেশ আবারও রাজনৈতিক সংকটে পড়বে।
বিএনপি এই অবস্থানের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে। ৭ নভেম্বর সংহতি দিবসের অনুষ্ঠানে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই গণভোট দাবিকে বলেন, “এটা মূলত নির্বাচনের পথে বাধা তৈরির ষড়যন্ত্র।”
অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে সাত দিনের সময় দিয়েছিল নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু সেই সময়সীমা শেষ হয়ে আসছে, সমাধানের কোনো ইঙ্গিত এখনো নেই।
জামায়াত একাধিকবার বিএনপিকে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে, কিন্তু বিএনপি সাড়া দেয়নি।
ঐকমত্য কমিশন নিয়েও জটিলতা বেড়েছে—বিএনপির অভিযোগ, তাদের ভিন্নমত কমিশনের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্যদিকে জামায়াত বলছে, বিএনপি ইচ্ছাকৃতভাবে বিভাজন তৈরি করছে।
জামায়াত ইসলামপন্থি দলগুলোকে এক ছাতার নিচে আনতে চেষ্টা করছে, কিন্তু হেফাজতে ইসলামের অভ্যন্তরে জামায়াতবিরোধী মনোভাব বেশ জোরালো। তবুও সম্ভাব্য আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা চলছে।
বিএনপির পুরোনো মিত্র জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এখনো তাদের পাশে। বামঘরানার কয়েকটি দলও বিএনপির ঘনিষ্ঠ অবস্থানে আছে।
অন্যদিকে জুলাই অভ্যুত্থানের পর আলোচনায় আসা নতুন দল এনসিপি এখনো নিজের অবস্থান নিয়ে দ্বিধায়। কেউ চান স্বতন্ত্রভাবে লড়তে, কেউ আবার বড় জোটে থাকতে আগ্রহী।
বিশ্লেষকদের মতে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দলগুলো যদি একমত না হয়, তাহলে সরকারের সিদ্ধান্ত কী হবে—তা এখনই বলা কঠিন। অনেকের আশঙ্কা, সরকার যদি চাপিয়ে দেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিকের মতে, “যে সমঝোতা আট মাসেও হয়নি, তা আট দিনে হওয়া প্রায় অসম্ভব। গণভোটের আগে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনই এখন সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ।”
সবকিছু মিলিয়ে জুলাই সনদ, গণভোট, এবং নির্বাচন—এই তিন অক্ষরের রাজনীতিই এখন দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
প্রশ্নটা তাই আগের মতোই থেকে যাচ্ছে—বাংলাদেশ কি আবারও রাজনীতির উত্তপ্ত পথে হাঁটছে?

