দুই ব্রিটিশ আইনজীবী জাতিসংঘে জরুরি আবেদন জানিয়েছেন, যেখানে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ‘গুরুতর উদ্বেগ’ প্রকাশ করা হয়েছে। লন্ডনের ডাউটি স্ট্রিট চেম্বার্সের আইনজীবী স্টিভেন পাওলস কেসি ও তাতিয়ানা ইটওয়েল এই আবেদন জমা দিয়েছেন।
তারা জাতিসংঘের বিচারক ও আইনজীবীদের স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ দূত এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিষয়ক বিশেষ দূতের কাছে আবেদনটি জমা দিয়েছেন।
আবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে চলমান বিচারপ্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনার ন্যায়বিচার ও আইনি অধিকার যথাযথভাবে রক্ষা করা হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, বিচার শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর কেন্দ্রীভূত, আর যারা ২০২৫ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত অভ্যুত্থানের পক্ষে ছিল, তাদের কর্মকাণ্ডের বিচার করা হচ্ছে না।
দুই আইনজীবী জানান, ট্রাইব্যুনালে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা প্রাধান্য পাচ্ছে এবং বিচার চলছে অনির্বাচিত সরকারের অধীনে, যাদের জনগণের কোনো নির্বাচিত ম্যান্ডেট নেই। তাদের মতে, এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আইনি মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আবেদনে শেখ হাসিনার আইনি অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে—
- স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতে বিচার না হওয়া: ‘ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস’ (আইসিসিপিআর) অনুচ্ছেদ ১৪(১) অনুযায়ী যে ধরনের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতে বিচার হওয়ার কথা, তা হাসিনার ক্ষেত্রে পালন করা হয়নি। এছাড়া বিচারক ও আদালতের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা দেখা যাচ্ছে।
- নোটিস ও উপস্থিতির অধিকার লঙ্ঘন: শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক নোটিস প্রদান করা হয়নি।
- আইনজীবী ও নিরাপত্তা সমস্যা: অতীতে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করা আইনজীবীদের ওপর হামলা, হুমকি ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এই ধরনের পরিস্থিতি বিচার প্রক্রিয়ার স্বাধীনতা ও ন্যায্যতা প্রভাবিত করছে।
- বেঁচে থাকার অধিকার লঙ্ঘন: অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড বা সমপরিমাণ সাজা প্রদানের প্রক্রিয়া আইসিসিপিআরের অনুচ্ছেদ ৬ অনুযায়ী শেখ হাসিনার বেঁচে থাকার অধিকার লঙ্ঘন করবে।

এছাড়া, আবেদনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে বাংলাদেশে বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং আইনি নীতিমালা নিশ্চিত হয়। দুই আইনজীবী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, অনির্বাচিত সরকারের অধীনে চলমান বিচারকাজে রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিহিংসা বিচার প্রক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করতে পারে।
এর আগে, গত কয়েক দিনে আওয়ামী লীগ অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে একাধিক অভিযোগ জানিয়েছে। দলটি জানিয়েছে, নেতাকর্মীদের হত্যা, নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের অভাব রয়েছে। গত মাসের শেষ দিকে নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত–আইসিসিতে একটি মামলার আবেদনও জমা পড়ে।
আবেদনটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনও, যিনি এক সময় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টকে ২৮ অক্টোবর একটি চিঠি পাঠিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নিপীড়ন, গুম, সেনা কর্মকর্তাদের মামলা, অপরাধীদের দায়মুক্তি এবং সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ধরেন।
আবেদনে দুই আইনজীবী কেসি ও ইটওয়েল উল্লেখ করেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব ও পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট। এই পরিস্থিতি শেখ হাসিনার ন্যায়বিচার প্রক্রিয়ায় অব্যাহতভাবে বাধা সৃষ্টি করছে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি অনুযায়ী তার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

