বিশ্বব্যাপী সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ শিল্পের বাজারে প্রবেশের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ এখন আরও বড় পদক্ষেপ নিচ্ছে। ১১ নভেম্বর থেকে মালয়েশিয়ার পেনাংয়ে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিএসআইএ)–এর তিনদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক রোডশো—নাম দেওয়া হয়েছে “সিলিকন রিভার”।
এই রোডশোর লক্ষ্য একটাই: মালয়েশিয়ার মতো উন্নত সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের দেশে বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা তুলে ধরা—যেখানে তরুণ চিপ ডিজাইন স্টার্টআপ, টেস্টিং প্রতিষ্ঠান, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিভাবান শিক্ষার্থীরা মিলে এক নতুন শিল্পযাত্রার গল্প লিখছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে সমন্বিত ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রচেষ্টা—দেশকে একটি উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন, ব্যয়-সাশ্রয়ী, উদ্ভাবনভিত্তিক চিপ ডিজাইন ও ইঞ্জিনিয়ারিং হাবে রূপ দেওয়ার পথে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
বিএসআইএ সভাপতি এম এ জব্বার বলেন, “মালয়েশিয়া চিপ প্যাকেজিং ও টেস্টিংয়ে বিশ্বের অন্যতম পরিণত বাজার। তারা অভিজ্ঞতা আর প্রযুক্তি দেবে, আমরা দেব তরুণ ডিজাইন প্রতিভা, উদ্ভাবন আর খরচে প্রতিযোগিতা। ‘সিলিকন রিভার’ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো এই দুই শক্তিকে একসাথে যুক্ত করা—যাতে বাংলাদেশও বৈশ্বিক উদ্ভাবনের অংশ হতে পারে।”
মালয়েশিয়ার বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন, ইনভেস্ট পেনাং, ডেলয়েট, ইনফিনিয়ন, এএসই, টিএফ-এএমডি, ইনারি, ইনফিনেক্সসহ বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগ সংস্থা এতে অংশ নিচ্ছে। বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকছেন পেনাংয়ের উপ–মুখ্যমন্ত্রী ওয়াইবি জগদীপ সিং দেও এবং বাংলাদেশ হাইকমিশনার মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী।
রোডশোতে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশের কয়েকটি অগ্রগামী চিপ কোম্পানি—
- উলাকসেমি ও নিউরাল সেমিকন্ডাক্টর (অ্যানালগ, আরএফ ও ফোটোনিক্স ডিজাইন),
- প্রাইম সিলিকন (ডিজিটাল ইমপ্লিমেন্টেশন ও ফাউন্ড্রি প্রস্তুতি),
- সিলিকোনোভা লিমিটেড (এআই-ভিত্তিক ডিজাইন অটোমেশন ও ওএসএটি সহযোগিতা),
- আই-টেস্ট বাংলাদেশ (চিপ টেস্টিং ও রিলায়েবিলিটি সেবা),
- আর ক্যাকটাস ম্যাটেরিয়ালস, যারা পাওয়ার ডিভাইস ও ফোটোনিক্স ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক।
এদের অংশগ্রহণ দেখাচ্ছে—কত দ্রুত বাংলাদেশ এই খাতে দক্ষতা, বৈচিত্র্য ও পরিণত এক ইকোসিস্টেম গড়ে তুলছে, যা এক দশক আগেও কল্পনাতীত ছিল।
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের সেমিকন্ডাক্টর খাতে এক ডজনেরও বেশি নতুন স্টার্টআপ গড়ে উঠেছে—অনেকগুলোই গড়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা মালয়েশিয়া থেকে ফেরা অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়াররা।
বুয়েট, চুয়েট, কুয়েট, আইইউটি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়সহ শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নিজস্ব ভিএলএসআই (Very Large Scale Integration) ল্যাব ও গবেষণা ইউনিট চালু করেছে।
বিএসআইএ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তিও করেছে।
পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ মুস্তাফা হোসেন বলেন, “বাংলাদেশের এই অগ্রগতি এখন বিশ্বজুড়ে নজর কাড়ছে। সিলিকন রিভার কেবল একটি উদ্যোগ নয়—এটি এক সেতুবন্ধন, যা বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্প, আর বৈশ্বিক প্রবাসী প্রতিভাকে একত্র করছে।
রোডশো থেকে বেশ কিছু বাস্তব ফলাফল প্রত্যাশা করা হচ্ছে—
চিপ ডিজাইন ও টেস্টিংয়ে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া যৌথ প্রকল্প,
বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পখাতের মধ্যে আইপি শেয়ারিং ও প্রশিক্ষণ সহযোগিতা,
এমনকি দ্বিপাক্ষিক ‘সেন্টার অব এক্সেলেন্স’ ও যৌথ ভেঞ্চার ল্যাব স্থাপনের পরিকল্পনাও আলোচনায় আছে।
শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শুধু প্রযুক্তির নয়, বরং বাংলাদেশের নতুন অর্থনৈতিক কূটনীতির সূচনা—যেখানে উদ্ভাবন, দক্ষতা আর আত্মবিশ্বাস মিলেই গড়ে উঠছে ভবিষ্যতের ‘সিলিকন রিভার বাংলাদেশ’।

