গত বৃহস্পতিবার ধানমন্ডি ৩২ এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাড়ির সম্মুখে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার ‘অপরাধে’ মবের শিকার সালমা ইসলাম নামে এক সাধারণ নারীকে হত্যাচেষ্টা মামলায় কারাগারে প্রেরণের ঘটনাটি যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, শুক্রবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার উপপরিদর্শকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত আদেশ দিয়াছেন আদালত।
উহাতে বলা হইয়াছে, পুলিশ তাঁহাকে গত বৎসরের জুলাইয়ে সংঘটিত ‘হত্যাচেষ্টার ঘটনায়’ ধানমন্ডি থানায় দায়েরকৃত মামলার ‘সন্দেহভাজন আসামি’ হিসাবে গ্রেপ্তার করিয়াছে। আইনজীবীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সালমা ইসলাম একজন গৃহিণী এবং ‘আবেগবশত’ ৩২ নম্বর বাড়িটির সম্মুখে গিয়া স্লোগান দিয়াছিলেন।
সংবাদমাধ্যম সমকালের মতে, খোদ তদন্ত কর্মকর্তাও সংবাদমাধ্যমকে বলিয়াছেন, ঐ নারী কোনো মামলার এজাহারভুক্ত আসামি নন; কেবল ‘উপরের নির্দেশে’ তাঁহাকে ‘সন্দেহভাজন আসামি’ করা হইয়াছে।
অর্থাৎ, গত বৎসর ১ ডিসেম্বর দায়েরকৃত মামলাটির ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামির তালিকায় উক্ত নারীর নাম অন্যায্যভাবে যুক্ত করা হইয়াছে। ইহা বুঝিবার জন্য আইনজ্ঞ হইবার প্রয়োজন নাই যে, নিছক হয়রানি ব্যতীত এই ঘটনার সহিত ন্যায়বিচারের সম্পর্ক নাই। এইরূপ অঘটন মানবাধিকারেও স্পষ্ট লঙ্ঘন।
আমরা বিস্মিত হইয়াছি, শত শত মানুষের দৃষ্টি ও ক্যামারার সম্মুখে যাহারা ঐ নারীকে প্রহার ও হেনস্তা করিয়াছে, পুলিশ তাহাদের গ্রেপ্তারে উদ্যোগী হয় নাই। অবশ্য, গত বৎসরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড ও প্রাণহানির ঘটনায় অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে যেই সংখ্যক ভুয়া ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের হইয়াছে, তাহার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশের অবকাশও সামান্য।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রতিবেদন প্রকাশিত ও সম্প্রচারিত হইয়াছে। ঐগুলিতে দেখা গিয়াছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও হত্যাপ্রচেষ্টার সূত্র ধরিয়া দায়েরকৃত মামলাসমূহের অধিকাংশই সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণহীন। ফৌজদারি মামলার ন্যূনতম নিয়মনীতি অনুসরণ না করিয়া দায়েরকৃত এহেন বহু মামলায় আসামির পরিচয়ই জানেন না মামলার বাদী কিংবা ভুক্তভোগী পরিবার। অনেক মামলায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক শত্রুদের আসামি করা হইয়াছে; এমনকি মামলা বাণিজ্যেরও অভিযোগ কম নহে।
উল্লেখ্য, এই সকল প্রশ্নবিদ্ধ মামলা লইয়া আইনজীবীসহ বিভিন্ন মহলে সমালোচনা উঠিলে সরকার ইতোপূর্বে বিষয়টি স্বীকার করিয়া প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল। খোদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এই পরিস্থিতি স্বীকার করিয়া বলিয়াছিলেন, তদন্তে নিরীহ কেহ যাহাতে হয়রানির শিকার না হন, সেই ব্যবস্থা লইবেন। কিন্তু আলোচ্য ঘটনা প্রমাণ করে, বাস্তবতা সামান্যই পরিবির্তিত হইয়াছে।
স্মরণ করা যাইতে পারে, গত ১৫ আগস্টও এক নিরীহ রিকশাচালককে এই ধানমন্ডি থানার পুলিশ অনুরূপ হত্যাচেষ্টা মামলার ‘সন্দেহভাজন আসামি’ হিসাবে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করিয়াছিল, যিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করিতে গিয়া ৩২ নম্বরে মব সহিংসতার শিকার হইয়াছিলেন। সেই ঘটনায় সমালোচনার ঝড় উঠিলে আদালত অভিযুক্তকে জামিন দেন এবং ঢাকা মহানগর পুলিশও উক্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার ব্যাখ্যা দাবি করে।
আমরা জানি, ক্ষমতাচ্যুত সরকারও বিশেষত বিরোধী পক্ষকে দমন করিবার অপকৌশল হিসাবে বায়বীয় মামলার আশ্রয় লইত, যেই অপকৌশলের সরাসরি শিকার ছিলেন জুলাইয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাকর্মীগণও। হতাশাজনক হইল, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এত ত্যাগের পরও মামলাবাজির মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দমনের সেই অশুভ প্রবণতার অবসান হইল না।
আমাদের প্রত্যাশা, অবিলম্বে উক্ত নারীকে মুক্ত করা হইবে এবং এই অপশাসনের ধারা অবসানে সম্ভাব্য সকল কিছু করা হইবে। আর যাহারা নিছক স্লোগান দিবার ‘অপরাধে’ ঐ নারীকে পুলিশে সোপর্দ করিবার পূর্বে প্রহার ও হেনস্তা করিয়াছে, তাহাদেরই বরং অবিলম্বে আইনের আওতায় আনিতে হইবে। বিশেষত যাহারা প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত ক্যামেরার সম্মুখে ঐ নারীকে প্রহার ও হেনস্তায় দ্বিধা করে নাই, তাহাদের উপযুক্ত শাস্তি বিধান করিতে হইবে আইনের শাসনের স্বার্থেই।
সূত্র: সমকাল

