শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়। জেলা সদর থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই উপকূলীয় উপজেলা সুন্দরবনের কোলঘেঁষায়। দোতলা–তিনতলা স্কুল থেকে চারপাশের জলরাশি ও গাছের সারি বাধাহীনভাবে দেখা যায়। উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নে অবস্থিত তিনতলা ভবনের স্কুলে ২২ সেপ্টেম্বর টানা বৃষ্টির মধ্যে পৌঁছাতে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। দুপুর ১২টায় স্কুলে পৌঁছে দেখা যায়, কয়েকটি ক্লাস চলছে, অন্য কয়েকটি ক্লাসের ছাত্রীরা উপস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছে। দশম শ্রেণির কয়েকজন ছাত্রী জানায়, ক্লাসে মেয়েদের সংখ্যা কম থাকায় উপস্থিতিও কম।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাল্যবিবাহের কারণে উপস্থিতি কম। চারজন দশম শ্রেণির ছাত্রী জানিয়েছে, তারা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্কুলে পড়ছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ছিল ৪০ জন। এর মধ্যে চারজন অন্য স্কুলে চলে গেছে। দশম শ্রেণিতে তাদের সংখ্যা ১৭। বাকি ২০ জনের বাল্যবিবাহ হয়েছে। অর্থাৎ দশম শ্রেণিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৫০ শতাংশ মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের মধ্যে শুধু একজন ক্লাসে ফিরেছে। বাকিরা অনেকেই মা হয়ে গেছে।
জেলার অন্যান্য স্কুলগুলোতেও পরিস্থিতি একই রকম। বাল্যবিবাহ নিরোধে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, সাতক্ষীরায় বাল্যবিবাহ হয় এমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া মেয়েদের ৩০ থেকে ৪৮ শতাংশ বাল্যবিবাহের কারণে দশম শ্রেণিতে পৌঁছায় না।
শ্যামনগর উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার মিনা হাবিবুর রহমান জানান, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উপজেলায় অন্তত ১৬০ ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। উপজেলায় ৩৬টি মাদ্রাসাসহ ৮২টি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০১২ জন। এর মধ্যে ৮০০ জনই মেয়ে। শিক্ষার্থীর ৭০ শতাংশই অনিয়মিত। ঝরে পড়ার হার ৩৫ শতাংশ। তার মধ্যে ২০ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার।
বাল্যবিবাহের কারণে স্কুল ও মাদ্রাসায় ছাত্রীদের উপস্থিতি কম। শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকরা বাধা দেয়। কেউ কেউ ভয় পায় এমপিওভুক্তি বা উপবৃত্তি বাতিল হতে পারে ভেবে। হাবিবুর রহমান বলেন, সরকার কঠোর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। বাল্যবিবাহ নিবন্ধন না হওয়ায়, বিবাহবিচ্ছেদ বা নির্যাতনের শিকার মেয়েরা আইনি প্রতিকার পান না।
৪ দিনে জেলার ৭টি স্কুল ও মাদ্রাসা পরিদর্শন করা হয়েছে। এছাড়াও ৪টি স্কুলের তথ্য আলাদা সংগ্রহ করা হয়েছে। দেখা গেছে, ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে।
মেয়ের বাল্যবিবাহ হওয়া পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা বা ‘ভালো ছেলে’ পাওয়াই প্রধান কারণ। কেউ কেউ বলছেন, ছেলেমেয়েরা নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছে।
২০২৩ সালে ব্র্যাকের ‘বর্ন টু বি আ ব্রাইড’ জরিপে দেখা যায়, মাধ্যমিক শিক্ষার শেষ পর্যায়ে থাকা ১৬–১৭ বছরের মেয়েরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। নবম শ্রেণির মেয়েদের বিয়ে হওয়ার হার ৪৬ শতাংশের বেশি। দারিদ্র্য বড় কারণ হলেও ধনী ও মধ্যবিত্ত পরিবারেও ৫০ শতাংশের বেশি বাল্যবিবাহ ঘটে। মূল কারণ—উপযুক্ত পাত্র পাওয়া (৪৪%), দারিদ্র্য (১৮%), যৌতুক না চাইয়া (১০%), নিরাপত্তাহীনতা (৭%)।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের ‘স্মল এরিয়া এস্টিমেশন’ প্রতিবেদনে সাতক্ষীরায় ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার ৬২ শতাংশের বেশি। শীর্ষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ (৬৫%)। ছেলেদের বাল্যবিবাহের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী শহরাঞ্চলে প্রতি হাজারে ৭৩ মেয়ে ও ১৪ ছেলে ১৫–১৯ বছর বয়সী বিয়ে করছে।
শহর ও গ্রাম—উভয় ক্ষেত্রেই বাল্যবিবাহ থেমে নেই। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাটকেখালীতে এক দশম শ্রেণির ছাত্রী দুই মাস ধরে অনুপস্থিত। বাড়িতে গেলে তার মা জানালেন, গরিব পরিবারের কারণে ও ভালো পাত্র পাওয়ায় তিনি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছাত্রী আর স্কুলে যাবে না।
স্কুলের শিক্ষকরা বলছেন, দরিদ্র এলাকায় অভিভাবকরা মেয়েদের পড়াতে চান না। কিছু মেয়ের পড়াশোনা ও স্বপ্ন পূর্ণ করার ইচ্ছা থাকে না। প্রেমের সম্পর্কেও কিছু মেয়ে বাল্যবিবাহের দিকে ধাবিত হয়।
শ্যামনগরের বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসার তথ্য অনুযায়ী, দশম শ্রেণিতে মেয়েদের অন্তত ১০–২৫ শতাংশ বাল্যবিবাহের শিকার হয়। শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, দারিদ্র্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাল্যবিবাহ হচ্ছে।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি–আগস্টে সাতক্ষীরায় ১১২টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে। অভিভাবকরা অনেক সময় অন্য এলাকায় বিয়ে দিয়ে প্রতিরোধের তথ্য ফাঁকি দেন। নজরদারির জন্য আলাদা কাঠামো, লোকবল এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের প্রয়োজন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলছেন, সাতক্ষীরা ও দেশের অন্যান্য জেলায় বাল্যবিবাহের চিত্র একই। স্কুলে শিক্ষাব্যবস্থা ব্যয়বহুল হওয়ায় দরিদ্র পরিবার মেয়েদের পড়াতে চায় না। স্কুল দূরে হওয়ায় নিরাপত্তাহীনতাও বড় কারণ। এছাড়াও সামাজিক মানসিকতা মেয়েদের পড়াশোনা কমাতে প্রভাব ফেলে। তিনি বলেন, উপবৃত্তি বাড়াতে হবে এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা দরকার।

