মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ায় দেশের রাজনীতিতে নতুন ধাক্কা লেগেছে। এই রায়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ধরনের জল্পনা, বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যৎ কৌশল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
গত সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই রায় ঘোষণা করেছে। একই মামলায় শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, আর পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
মামলাটি জুলাই ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। অভিযোগপত্র দাখিলের মাত্র চার মাস সাত দিনের মধ্যেই রায় ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ের পরই আওয়ামী লীগ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। শেখ হাসিনা নিজে রায়কে “পক্ষপাতমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং জাতিসংঘ এই দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে বিচার হওয়া উচিৎ ছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই রায় দেশের রাজনীতিকে আরও মেরুকরণে ঠেলে দিতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, “যদি বিচার প্রক্রিয়া সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে তা দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক হবে। কিন্তু কোনো ফাঁকফোকর থাকলে রাজনৈতিক বিভাজন আরও গভীর হবে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হবে না, বরং রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকবে।”
গত বছর অক্টোবর মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে আনা সংশোধনীর ফলে মানবতাবিরোধী মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। রায়ের ফলে শুধু শেখ হাসিনা নয়, এই মামলায় অভিযোগ থাকা অন্য নেতারাও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। এতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম আগের তুলনায় আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবায়দা নাসরীন বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক চাপও গুরুত্বপূর্ণ। রায়ের প্রভাব শুধু দেশে নয়, প্রতিবেশী দেশ ও বিশ্বমঞ্চেও দেখবে। বিশেষ করে ভারতের অবস্থান এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তির প্রতিক্রিয়া দেশের রাজনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১৫ বছরের শাসনামলে বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন, গুম এবং হত্যা মামলার অভিযোগ রয়েছে। ২০১০ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত ও বিএনপির কয়েকজন নেতা বিচারিত হয়ে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, এই রায়ের ফলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পরিষ্কার সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। ভারতে বসে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যক্রম সীমিত হবে, এবং পশ্চিমা দেশ ও ভারতের চাপও এখন কমে যাবে।
তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা দ্রুত দেশে ফিরে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হবে, আর বিরোধী পক্ষ রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হবে।”
সংক্ষেপে, রায়টি দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রকে পাল্টে দেবে। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া, দলগুলোর অবস্থান এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা—সব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক ধারা শুরু হতে যাচ্ছে।

