রংপুর সিটি করপোরেশনের সড়ক উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা নগরবাসীর ভোগান্তিকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সিটি করপোরেশনের প্রস্তাবিত ১৬০০ কোটি টাকার সড়ক সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্প দুই বছর ধরে ফাইলবন্দি পড়ে আছে। ফলে রংপুরের প্রধান প্রধান সড়কগুলো ভেঙে পড়লেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শহীদ আবু সাঈদ রংপুরকে দেশের সেরা উন্নত জেলায় পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন নগরবাসী।
ইউনূস সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের ১৬ মাস পার হলেও স্থানীয় মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এই প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় আটকে রয়েছে। এতে নগরবাসীর ক্ষোভ আরো বেড়েছে। অনেকেই অভিযোগ করছেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে রংপুরকে উন্নয়ন পরিকল্পনার বাইরে রেখে দেওয়া হচ্ছে।

কোথায় আটকে রইল ১৬০০ কোটি টাকার পরিকল্পনা-
রংপুর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে রাস্তা প্রশস্তকরণ, সংস্কার ও মেরামত, ড্রেনেজ উন্নয়ন, শ্যামাসুন্দরী খালের ওপর ব্রিজ নির্মাণসহ নানাবিধ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৬৫৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়। এটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু শেখ হাসিনার পতিত সরকার বারবার আশ্বাস দিলেও একনেক সভায় প্রকল্পটি ওঠেনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে প্রকল্পটি অনুমোদনের প্রত্যাশা আরো জোরদার হয়। তবে ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রথম একনেক সভার আগে ১৫ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশন জানায়—বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রংপুর সিটির রাস্তা সংস্কার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন জরুরি নয়। এরপর থেকেই প্রকল্পটি কাগজে-কলমে আটকে রয়েছে।

এক-তৃতীয়াংশ সড়ক অচল, দুর্ঘটনায় নিত্যজীবন বিপর্যস্ত-
রংপুর সিটির মোট সড়কপথ ১৪৫৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৯৫৩ কিলোমিটার পাকা পথ হলেও প্রায় ৩০০ কিলোমিটার অংশ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। খানাখন্দ, উঁচু-নিচু গর্ত, উঠে যাওয়া পিচ—সব মিলিয়ে এক-তৃতীয়াংশ সড়কই এখন ঝুঁকিপূর্ণ। গত বর্ষায় এইসব সড়কে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন শতাধিক পথচারী।
জাহাজ কোম্পানি থেকে সাতমাথা, সার্কিট হাউস সড়ক, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বুড়িরহাট, মেডিকেল থেকে মডার্ন মোড়—প্রায় সব সড়কেই একই চিত্র। কোথাও কোথাও পুরো সড়কের পিচ উঠে গর্ত খালে পরিণত হয়েছে। যানচালকদের দুর্ভোগ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে রিকশা থেকে ট্রাক—সব ধরনের গাড়ি বিকল হয়ে যাচ্ছে। ধুলার কারণে শ্বাসকষ্ট, চোখের সংক্রমণও বাড়ছে। স্কুলগামী শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ রোগীদের দুর্ভোগ আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

নাগরিক ক্ষোভ: আন্দোলন, প্রতীকী জানাজা, ধান রোপণ-
জাহাজ কোম্পানি মোড় থেকে সাতমাথা পর্যন্ত সড়কটি বছরজুড়েই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় বাসিন্দারা সড়কের বেহাল দশার প্রতিবাদে গায়েবানা জানাজা পড়েছেন, সড়কে ধান রোপণ করেছেন। তারপরও বরাদ্দের অভাবে সিটি করপোরেশন কোনো টেকসই সংস্কার কাজ করতে পারেনি।
রিকশাচালক নুরুল হক বলেন, “এক গর্ত শেষ না হতেই আরেকটা শুরু হয়। প্রতিদিন রিকশা ভাঙে, যাত্রী পড়ে যায়। দুর্ঘটনা লেগেই থাকে।”
সিগারেট কোম্পানি এলাকায় ব্যবসায়ী শামছুল মিয়া বলেন, “হেঁটে চলা যায় না, যানবাহন তো দূরের কথা। মোটরসাইকেল আরোহীরা প্রতিনিয়ত আহত হচ্ছে।”
শাপলা চত্বরের কলেজছাত্রী মাসুমা আক্তার বলেন, “বিভাগীয় শহর বলা হলেও রাস্তাঘাট দেখে তা বোঝার উপায় নেই। গ্রামের অনেক রাস্তা এখানকার চেয়ে ভালো।”
বুড়িরহাট রোডের নিয়মিত যাত্রী তাজিদুল ইসলাম জানান, “এই সড়ক ধরে প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ যাতায়াত করেন। সড়কের এই অবস্থায় গাড়ির যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে, দুর্ঘটনাও বাড়ছে।”

সাবেক মেয়র ও বর্তমান নিয়ন্ত্রক বিভাগের বক্তব্য-
রংপুর সিটির সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা মনে করেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধাক্কায় প্রকল্পটি ঝুলে গেছে। তিনি বলেন, “আমি দায়িত্বে থাকাকালে মহাপরিকল্পনাটি পাঠিয়েছিলাম। পরে গণঅভ্যুত্থানের পর তা আর অগ্রগতি পায়নি। অন্তর্বর্তী সরকারও এখনো প্রকল্পটি অনুমোদন করেনি।”
সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আজম আলী জানান, “প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। অনুমোদন পেলে সড়ক উন্নয়ন দ্রুত শুরু করা সম্ভব হবে। আমরা জানি মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে; কিন্তু বরাদ্দ না পেলে বড় ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়। অস্থায়ী মেরামতের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে।”
নাগরিকদের দাবি: বৈষম্যের অবসান, ন্যায্য বরাদ্দ প্রয়োজন-
সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন রংপুর জেলা সভাপতি অধ্যক্ষ খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, “বিগত সরকার আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় রংপুরের প্রকল্প আটকে রেখেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের আগমনে ভেবেছিলাম সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু ১৬ মাসে কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমরা প্রতিশ্রুতি নয়, ন্যায্য বরাদ্দ চাই। উন্নয়ন বৈষম্য থেকে মুক্তি চাই।”

