গত শুক্রবার সকাল থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চারবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। প্রতিবারই সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়েছে। যদিও ভূমিকম্প নিয়ে আলোচনা ও সতর্কবার্তা দেওয়া হয়, বাস্তবে প্রস্তুতি নেওয়ার প্রচেষ্টা অদৃশ্য। সপ্তাহের মধ্যে সব আলোচনা শেষ হয়ে যায়, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপের দেখা মেলে না।
ঢাকা, দেশের সবচেয়ে ঘন বসতি সম্পন্ন শহর, এখানে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। অতীতে বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনার কথা বলা হলেও অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। সরকারি দাবি “মোটামুটি প্রস্তুতি আছে”, কিন্তু মাঠ পর্যায়ে তা দেখা যায় না। যা কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা অপ্রতুল এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে টুকরোভাবে রয়েছে।
সরঞ্জাম ও মহড়া ব্যবহার হয় না
ঘূর্ণিঝড় গবেষণা কেন্দ্র কার্যক্রম চালাচ্ছে, কিন্তু যন্ত্রপাতি ব্যবহার না হওয়ায় কার্যকর হচ্ছে না। দুর্যোগে তৎপরতা দেখানোর জন্য জরুরি পরিচালন কেন্দ্র তৈরি হলেও জনবল নিয়োগ হয়নি। মহড়া বা সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেই। বড় ধরনের ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রায় শূন্য। উদ্ধার অভিযান পরিচালনায় ফায়ার সার্ভিসও প্রস্তুত নয়। ঢাকায় জনবসতির কারণে খোলা জায়গা নেই, ফলে মানুষ ভূমিকম্পে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারছে না।
ভুল তথ্য জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করছে
ভূমিকম্পের উৎস, মাত্রা ও ঝুঁকি শনাক্ত করার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রেও সমস্যার আঁচ রয়েছে। গত শনিবারের ভূমিকম্পের পর উৎপত্তিস্থল বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রথমে গাজীপুর দেখানো হয়েছিল, পরে নরসিংদী। সন্ধ্যার ঘটনায় ঢাকার বাড্ডা দেখানো হলেও পরে নরসিংদী-ঢাকা অঞ্চলে পরিবর্তন করা হয়। এর ফলে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
সংস্থাটির ১০টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থাকলেও, সারাদেশের ডেটা বিশ্লেষণ করতে আছে মাত্র একজন আবহাওয়াবিদ ও একজন সহকারী। আধুনিক সফটওয়্যার নেই, তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণও সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পপ্রবণ দেশের জন্য দ্রুত ও নির্ভুল পর্যবেক্ষণ অত্যাবশ্যক।
ঢাকায় নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব
ঢাকায় ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে মানুষ হঠাৎ দুলতে থাকা ভবন থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। কিন্তু খোলা জায়গা না থাকায় অনেকে সরু গলি বা উঁচু ভবনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকায় প্রতিটি এলাকার হাঁটা-দূরত্বে খোলা মাঠ বা পার্ক থাকা উচিত। তবে ঢাকা শহরে সবুজ এলাকা মাত্র ৫ শতাংশের নিচে, যা আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে অনেক কম।
সরঞ্জামের অভাব ও অপ্রয়োগ
সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর সরকার যে বিপুল সরঞ্জাম কিনেছিল, তার বেশির ভাগ ব্যবহার হয়নি। BUET-এর অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, অন্তত ২০০ কোটি টাকার সরঞ্জাম ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সংস্থাকে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু দীর্ঘ দিন বড় দুর্যোগ না হওয়ায় সেগুলো অকেজো হয়ে গেছে।
প্রযুক্তিগত সক্ষমতা শূন্য
বড় ধরনের ভূমিকম্প মোকাবিলায় দেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রায় শূন্য। দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, বড় ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশ একা কিছু করতে পারবে না, বাইরের সহায়তা প্রয়োজন হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও স্বীকার করেছেন, প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি সম্পূর্ণ নেই।
ফায়ার সার্ভিস ও জনবল সংকট
ফায়ার সার্ভিস দেশের প্রথম প্রতিক্রিয়া সংস্থা হলেও জনবল ও যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। ঢাকা শহরে ৬৫০ জন কর্মী রয়েছে, যখন বহুতল ভবনের সংখ্যা ২১ লাখের বেশি। বড় ভবন ধসে সড়ক বন্ধ হলে উদ্ধার অভিযান অসম্ভব। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের মধ্যে আছে হাইড্রোলিক কাটার, র্যাম, সার্চ ভিশন ক্যামেরা, থার্মাল ইমেজার ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোর যথেষ্ট মজুত নেই।
ভলান্টিয়ার নিয়েও সংকট রয়েছে। ২০১০ সালে তিন লাখ শহরভিত্তিক ভলান্টিয়ার তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হলেও বাস্তবে সংখ্যা মাত্র ৪০ হাজার।
সমন্বিত পদক্ষেপ অপরিহার্য
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সেখ ফরিদ আহমেদ বলেন, শুধুমাত্র রাষ্ট্রই যথেষ্ট নয়, নাগরিককেও দায়িত্বশীল হতে হবে। আইন, নীতি ও বাস্তবায়নসহ সকল অংশীজনের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া টেকসই সমাধান সম্ভব নয়।

