বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রতি বছরই বড় অঙ্কের লোকসানে পড়ছে। পরিচালন খাতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আয় থাকলেও সংস্থাটি লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারছে না। পরিচালন আয়-ব্যয়ে উল্লেখযোগ্য লাভ থাকলেও সংস্কার, মেরামত ও ওয়েলফেয়ার খাতের অতিরিক্ত ব্যয় রেলকে ঘুরপাক খাইয়ে রাখছে ক্ষতির চক্রে।
সম্প্রতি রেলওয়ের নিজস্ব অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে এসেছে। পূর্ব ও পশ্চিম—উভয় অঞ্চলের মাঝারি মানের ১০টি স্টেশনকে কেন্দ্র করে হওয়া এই আয়-ব্যয়ের বিশ্লেষণে দেখা যায় ভিন্নধর্মী বৈসাদৃশ্য। রেলের দুই অঞ্চলের মধ্যবর্তী এলাকা থেকে বাছাই করা পাঁচটি করে মোট ১০টি স্টেশনকে ভিত্তি স্টেশন ধরা হয়। রেলওয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিচালন খাতে যত আয় হয় তার মাত্র এক-দশমাংশ ব্যয় করতে হয়। অর্থাৎ পরিচালনায় ১০ টাকা আয় হলে ব্যয় লাগে মাত্র ১ টাকা। বাকি ৯ টাকা ব্যয় হয় যন্ত্রাংশ ক্রয়, মেরামত, সংস্কারসহ অন্যান্য খাতে। তবুও ঘাটতি থেকে যায়।
এই হিসাব অনুযায়ী, রেলওয়ে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লোকসানের বোঝা টানছে। অপারেটিং বিভাগ নির্ধারিত আয়-ব্যয় মেনে চললেও প্রকৌশল বিভাগের তুলনামূলক বেশি ব্যয় রেলওয়েকে লোকসান থেকে লাভে ফিরতে দিচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে টানা লোকসানে থাকা বাংলাদেশ রেলওয়ের ক্ষতি কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে। রেলওয়ে প্রশাসন ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে ব্যয় কমিয়ে আয় বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। এসব বৈঠকে উঠে আসে রেলের উদ্বেগজনক চিত্র—১ টাকা আয় করতে সংস্থাটিকে ব্যয় করতে হচ্ছে আড়াই টাকারও বেশি।
পরিচালন ব্যয় তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রিত হলেও সিভিল ও মেকানিক্যাল খাতে ব্যয় এত বেশি যে যাত্রী, মালবাহী, পার্সেল, ভূসম্পত্তি, স্ক্র্যাপসহ বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া আয় পিছিয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে আয়-ব্যয় সামঞ্জস্য করতে রেলওয়ে মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান চালায় এবং নির্বাচিত ১০টি স্টেশনের বিশদ তথ্য সংগ্রহ করে। নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রধান স্টেশনগুলো বাদ দিয়ে পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, চুয়াডাঙ্গা, নাটোর, জয়পুরহাট ও দিনাজপুর স্টেশনকে মাসিক ও বার্ষিক আয়-ব্যয়ের জন্য বাছাই করা হয়। এ বিষয়ে চলতি বছরের ৭ মে পশ্চিমাঞ্চল রেলের মহাব্যবস্থাপক প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তাকে চিঠি দেন।
নির্দেশনা অনুযায়ী ট্রাফিক (বাণিজ্যিক ও অপারেশন), বৈদ্যুতিক, আরএনবি, মেডিকেল, সিগন্যাল, যান্ত্রিক, প্রকৌশল, ভূসম্পত্তি ও হিসাব বিভাগে কর্মরত জনবলের বেতন-ভাতা, পোশাক সরবরাহ, পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী, কাগজপত্র ক্রয়, কর্মচারীদের পোশাক-পরিচ্ছদ, সহজ (জেভি)-এর টিকিট বিক্রির কমিশন এবং পিটি রিপেয়ারের মতো খরচ হিসাবভুক্ত করে মাসিক ও বার্ষিক ব্যয় নির্ধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়। পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তাকে চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল একই নির্দেশনা পাঠানো হয়।
গত ২৪ মে পশ্চিমাঞ্চল রেলের বাণিজ্যিক বিভাগ পাঁচটি স্টেশনের আয়-ব্যয়ের হিসাব জমা দেয়। সেখানে দেখা যায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাঁচ স্টেশনে মোট আয় হয়েছে ৬৪ কোটি ৬৩ লাখ ৪৮ হাজার ৭২০ টাকা। এর বিপরীতে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫ কোটি ৬১ লাখ ১৭ হাজার ২০৮ টাকা। nঅন্যদিকে পূর্বাঞ্চলের নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী ও জামালপুর স্টেশনে একই সময়ে আয় হয়েছে ৫০ কোটি ৪৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০৮ টাকা এবং ব্যয় হয়েছে ৭ কোটি ৩৩ লাখ ৩০ হাজার ৮৯৬ টাকা। গত ২৭ আগস্ট মহাব্যবস্থাপকের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে ট্রাফিক, বৈদ্যুতিক, আরএনবি, সিগন্যাল ও প্রকৌশল বিভাগের ব্যয় এবং বাণিজ্যিক বিভাগের আয়কে মূল বিবেচনায় নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বণিক বলেন, ‘আয়-ব্যয়ের অনুপাত কমিয়ে রেলকে লাভজনক করার পাশাপাশি সেবার মান উন্নয়নে কাজ শুরু করেছি। এর অংশ হিসেবে দেশের কিছু স্টেশনের আয়-ব্যয়ের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সেই বিশ্লেষণের পর ব্যয় কমানো ও আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, লাভজনক রুটে ট্রেন সংখ্যা বাড়ানো, রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে নিয়মিত মনিটরিং এবং ট্রেনে আসন পূরণ নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অপারেশন ও বাণিজ্যিক বিভাগে আয় সন্তোষজনক হলেও ব্যয়ের খাতগুলো কঠোর নজরদারিতে আনা হচ্ছে। তার দাবি, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই এসব উদ্যোগের দৃশ্যমান অগ্রগতি পাওয়া গেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগোলে দ্রুত রেলকে লাভজনক স্থানে নেওয়া সম্ভব।
রেলওয়ের আয় কাঠামোতেও বৈসাদৃশ্য রয়েছে। যাত্রীবাহী ট্রেনের ৯৫ শতাংশ লোকসানে চললেও প্রায় সব পণ্যবাহী ট্রেন লাভে আছে। তবুও অনুসন্ধানে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলের প্রধান স্টেশনগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। অর্থাৎ ঢাকা (কমলাপুর), বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেটসহ প্রথম শ্রেণির বড় স্টেশনগুলো বাদ দিয়ে আয়-ব্যয়ের হিসাব করা হয়েছে। এসব প্রধান স্টেশনেই সর্বাধিক টিকিট বিক্রি হয় এবং পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলের আয় জমা পড়ে। ফলে এই স্টেশনগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করলে ব্যয়ের তুলনায় আয় আরও বেশি দেখানোর সম্ভাবনা রয়েছে। মধ্যবর্তী স্টেশনের আয়-ব্যয় বিশ্লেষণ করে রেলওয়ের লোকসানের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে কাজ করবে মার্কেটিং ও পরিকল্পনা বিভাগ।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিচালন ও বাণিজ্যিক বিভাগ সারা দেশের ৫৩৩টি স্টেশন থেকে মোট আয়ের বড় অংশ করছে। জরিপ করা স্টেশন ছাড়াও অন্যান্য স্টেশন প্রায় একই ধরনের আয় করলেও ব্যয় কম। কিন্তু প্রকৌশল বিভাগ ট্রেন মেরামত, যন্ত্রাংশ ক্রয়, ট্র্যাক মেরামত, অফিস ও আবাসনের সংস্কারসহ বিভিন্ন খাতে বড় অঙ্কের ব্যয় করে। এ কারণে রেলওয়ে সারা দেশে ৩ হাজার ৪২২ কিলোমিটার রুটে দৈনিক ৩৩৭টি যাত্রীবাহী ও ২১টি পণ্যবাহী ট্রেন চালালেও প্রকৌশল খাতের অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে লাভের ধারায় ফিরে আসতে পারছে না। পাশাপাশি, আগের সরকারের সময়ে রেলের বিভিন্ন কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এবং কিছু প্রমাণিতও হয়েছে।
পূর্বাঞ্চল রেলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সুবক্তগীন বলেন, ‘রেলওয়ের ওয়েলফেয়ার খাতে পেনশন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে বিপুল ব্যয় হয়। এটি রেলকে লাভজনক করতে প্রতিবন্ধক। কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগের ফল আমরা দেখতে শুরু করেছি। লোকোমোটিভ ও কোচ ক্রয়ের মাধ্যমে চাহিদাসম্পন্ন রুটে সার্ভিস বাড়ানো এবং পণ্যবাহী ট্রেনের গুরুত্ব দেয়ায় লোকসান কমানো সম্ভব। মাঠপর্যায়ের স্টেশনগুলোর আয়-ব্যয়ের চিত্র পর্যালোচনা করে অতিরিক্ত ব্যয়ের খাত চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হবে।’
রেলের বাণিজ্যিক ও পরিকল্পনা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, রেলের অপারেশন বিভাগ (ট্রাফিক ও কমার্শিয়াল) মোট আয়ের ৯৫ শতাংশের বেশি অর্জন করে। তবে যাত্রীসেবা বাড়ানো বা আয় বাড়াতে ন্যূনতম ব্যয় করার ক্ষমতা নেই এ বিভাগের। ট্রেন চলাচল ও আয় বাড়াতে তাদের নির্ভর করতে হয় প্রকৌশল বিভাগের ওপর। অনেক ক্ষেত্রেই অপারেশন বিভাগের মতামত উপেক্ষিত হয়। তবু এ বিভাগের ওপরই আয় বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। তারা মনে করেন, নিয়মিত লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে আয় বৃদ্ধি করা হলেও ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ আনা গেলে রেলওয়ে লাভের ধারায় ফিরে আসতে পারবে।
প্রসঙ্গত, প্রতি বছর রেলের আয় ১০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারিত আছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পশ্চিমাঞ্চল রেলের আয় হয়েছে ১৭০ কোটি ৯ লাখ ৭২ হাজার টাকা, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে আয় ছিল ১৩৩ কোটি ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চল রেলের প্রথম প্রান্তিকের আয় হয়েছে ৩১০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, আগের অর্থবছরে ছিল ২০৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রথম প্রান্তিকে উভয় অঞ্চলে রেলের আয় বেড়েছে ১৪২ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপারেশন বিভাগে আয় বাড়লেও সার্বিক ব্যয়ের বেড়ে যাওয়া কারণে রেলওয়ে এখনও লাভের মুখ দেখতে পারছে না।

