অসুস্থ হলে হাসপাতালে দৌড়ে যাওয়া মানুষের স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েক দফা ভূমিকম্প ঢাকাবাসীর মনে নতুন প্রশ্ন তুলেছে—জরুরি সময়ে আমরা যে হাসপাতালে ছুটে যাব, সেই ভবনগুলো নিজেরাই কতটা নিরাপদ?
গত কয়েক সপ্তাহে ভূমিকম্পের পর শহরের মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে হাসপাতালের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা। বিশেষ করে বহু বছরের পুরোনো ভবনে যে এখনও চিকিৎসা চলছে—এটি অনেকের মধ্যেই আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে।
ঢাকায় ২৪৮ হাসপাতাল ঝুঁকিপূর্ণ—১৭৪ অতি ঝুঁকিতে
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ২০১৭ সালে যে জরিপ করেছিল, সেখানে দেখা যায়—ঢাকার ৪৩৩টি হাসপাতালের মধ্যে ২৪৮টিই ঝুঁকিপূর্ণ; আর এর মধ্যে ১৭৪টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ। আশঙ্কার বিষয় হলো—ঢাকায় যে পাঁচটি বড় হাসপাতালের ওপর সবচেয়ে বেশি মানুষ নির্ভর করেন, সেগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। তালিকায় রয়েছে:
-
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
-
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল
-
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি হাসপাতাল)
-
জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন হাসপাতাল (পঙ্গু হাসপাতাল)
-
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট
এসব ভবনের বয়স ৫০ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে। পুরোনো কাঠামো, ঝুলে থাকা পলেস্তারা, বারবার ছাদ খসে পড়ার ঘটনা অনেক জায়গায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘ঝুঁকিতে থাকা ভবনে চিকিৎসা চলছে—এটা নিজেই বিপদ’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরীর মতে, যদি হাসপাতাল নিজেই বিপজ্জনক অবস্থায় থাকে, তবে রোগীদের চিকিৎসা দেখবে কে? তিনি মনে করেন, ভবনগুলোর অবস্থা মূল্যায়নের জন্য একটি শক্তিশালী বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা জরুরি। কোন ভবন রাখা যাবে, কোনটি বাদ দিতে হবে—এমন সিদ্ধান্ত প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণের মাধ্যমেই নিতে হবে।
ভয় আর অনিশ্চয়তায় ঢাকাবাসী
দেড়–দুই কোটি মানুষের শহর ঢাকায় এখন ভূমিকম্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকট। সোমবার রাতেও ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর অনেকেই বাইরে ছুটে যান। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন—একটি বড় ভূমিকম্প হলে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা ভেঙে প্রচুর মানুষ হতাহত হতে পারে। অথচ মানুষের প্রথম আশ্রয়স্থান হাসপাতালগুলোর অবস্থাই প্রশ্নের মুখে।
রাজউকের পর্যবেক্ষণ: নতুন কোড, কঠোর মনিটরিং
রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম জানান—ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্তে তাদের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ৩০০–এর বেশি ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে; প্রশাসনিক ভবন থেকে শুরু করে বাসাবাড়ি—সবখানেই নজরদারি রয়েছে। তিনি বলেন, নতুন ভবন নির্মাণে ৭–৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীলতার মান বজায় রাখতে কড়া মনিটরিং করা হচ্ছে।
হাসপাতালগুলোর বাস্তব চিত্র—ঢামেক থেকে পঙ্গু হাসপাতাল
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতালটির মূল ভবনের বয়স ১২০ বছর। পলেস্তারা খসে পড়া, সিলিং রড বেরিয়ে আসা, পানি চুইয়ে পড়া—এগুলো সাধারণ ঘটনা। কয়েকবার রোগী ও চিকিৎসক আহতও হয়েছেন। ভবনের অংশ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও জায়গা সংকটে শিক্ষার্থীরা এখনো থাকছেন।
মিটফোর্ড হাসপাতাল
পুরান ঢাকার মিটফোর্ডের ভবনগুলোর অনেকের বয়স দেড়শ বছর। চিকিৎসক ও রোগীদের মতে, ছাদের পলেস্তারা পড়া এখানে নিত্যদিনের ব্যাপার। গণপূর্ত বিভাগ ২০০৯ সালেই চারটি ভবনকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করার সুপারিশ করেছিল, কিন্তু কার্যত কিছুই হয়নি।
পঙ্গু হাসপাতাল
২০১৯ সালে এক হাজার শয্যার নতুন ভবন উদ্বোধনের পর ২০২৪ সালের ভূমিকম্পে ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। যদিও পিডব্লিউডি বলছে, এগুলো বড় ধরনের ক্ষতি নয়; তবে রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি)
রাজউক পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপে ‘এ’ ও ‘বি’ ব্লকের দুইটি ভবনকে অত্যন্ত বিপজ্জনক ঘোষণা করা হয়েছে। এই ভবনেই রয়েছে আবাসন, ক্যান্টিন, প্রশাসনিক কার্যক্রম।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল
পিডব্লিউডি ২০১৪ সালেই ‘এ’ ব্লকের চতুর্থ তলা এবং নিটোর স্টাফ কোয়ার্টারকে ঝুঁকিপূর্ণ বলেছিল। তবু সেখানে আবাসন ও একাডেমিক কার্যক্রম চলছিল। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের পর মিলনায়তন ও লাইব্রেরি বন্ধ করা হয়েছে, তবে কোয়ার্টার কেউ ছাড়েনি।
২১ নভেম্বরের ভূমিকম্প—হাসপাতালে যে দৃশ্য দেখা গেছে
শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে দুই বছরের শিশুর হাত ধরে থাকা তাহমিনা বেগম জানান—ভূমিকম্প শুরু হতেই নার্সরা দৌড়ে বেরিয়ে যান। অক্সিজেন লাগানো শিশু, স্যালাইন চলা রোগী—সবার দেখভালের দায়িত্ব তখন অভিভাবকদের ওপরই পড়ে। এই ঘটনাই প্রশ্ন তোলে—ভূমিকম্পে যদি আবার বড় মামলা হয়, তবে হাসপাতালগুলো কি সেই চাপ সামলাতে পারবে?

