রাজধানী ঢাকা যেন এক বিশাল অনিয়মের শহর। রাজউকের আওতাধীন ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্রায় ২২ লাখ ভবন দাঁড়িয়ে আছে—কিন্তু বিস্ময়করভাবে এর মধ্যে প্রায় ২১ লাখই নির্মিত হয়েছে দুর্বল ভিত্তির ওপর। বিল্ডিং কোড মানা হয়নি, নেয়া হয়নি সঠিক নকশা, আর অনুমোদনহীন নির্মাণ তো আছেই। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়—সরকারিভাবে নির্মিত নতুন ভবনের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে শনাক্ত হয়েছে।
রাজউকের তথ্য বলছে, এই বিপুল সংখ্যক ভবনের মধ্যে ১৫ লাখ ভবন দুই তলা বা তার কম, যেগুলোতে তুলনামূলক ক্ষতির ঝুঁকি কম। তবে চার তলা থেকে ৩০ তলা পর্যন্ত থাকা প্রায় ৬ লাখ ভবন রয়েছে উচ্চঝুঁকিতে। নগর পরিকল্পনাবিদদের সতর্কবার্তা স্পষ্ট—বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ঢাকা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।
ভূমিকম্পের পর তৎপরতা—কিন্তু কতটা টেকসই?
গত দুই দিনে দেশে তিনবার ভূমিকম্প হওয়ায় রাজধানীতে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ঘটনার পরই রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম ঘোষণা দেন যে দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো শনাক্ত ও পরিদর্শন করা হবে। বংশাল এলাকার ভবন পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, পুরান ঢাকায় বহু ভবন কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই নির্মিত, যেখানে এক কাঠারও কম জায়গায় ৬–৭ তলা পর্যন্ত ভবন দাঁড়িয়ে গেছে।
এদিকে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ পুরোনো ভবনই কোড না মেনে বানানো। তাঁর ভাষায়, সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে—ঢাকা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।
অপ্রস্তুত শহর, ভঙ্গুর ভবন
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ ভবনই ২০–৩০ বছর আগে নির্মিত। তখন নকশা যাচাই কিংবা নির্মাণমান নিয়ন্ত্রণ ছিল অত্যন্ত দুর্বল। শহরের বহু এলাকাই এমন, যেখানে মাটির ধরন মোটেই বহুতল ভবন সহ্য করার মতো নয়। তার ওপর অনুমোদনবিহীন নির্মাণের দাপট—যেটি এখন বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে শহরকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে,
-
অনেক ভবনেই নেই ভূমিকম্প-সহনশীল ডিজাইন
-
নেই পর্যাপ্ত খোলা জায়গা বা সেফটি জোন
-
সংকীর্ণ গলির কারণে উদ্ধারকাজ হবে কঠিন
-
বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইনের অপরিকল্পিত সংযোগ বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে
ঢাকার ভবন নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হয় কেবল দুর্ঘটনার সময়ই। মানুষের মৃত্যু ঘটলেই কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেন, এরপর আবার সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরে যায়—এটাই যেন রীতি।
তথ্যের ভয়াবহতা: ৭৪% ভবন নকশাবহির্ভূত
রাজউকের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরের ৭৪ শতাংশ ভবনই নকশাবহির্ভূতভাবে নির্মিত। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি হলেও সেগুলো ভাঙা বা পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সেফটি অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে—ঢাকার প্রায় ২১ লাখ ৪৬ হাজার ভবন বিপজ্জনক। সঠিক ভূমিকম্প হলে এগুলো প্রকৃত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতে পারে।
বিশ্বব্যাংক–সহায়িত আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের জরিপে আরও চমকে ওঠার মতো তথ্য পাওয়া গেছে—সরকারি নতুন ভবনের ৩৭ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। তার মধ্যে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ১৭ তলা ভবন পর্যন্ত রয়েছে।
স্থপতি ও নগরবিদদের মতে, ঢাকার প্রায় ১৩ শতাংশ জায়গা ভবন নির্মাণের অনুপযোগী হলেও তাতেও ভবন উঠে গেছে। কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে না ফেলে নতুন ভবন নির্মাণের প্রবণতা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলছে।
ঢাকা এখন যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, তাতে বড় ধরনের শব্দেই শহরটি ধসে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কা বাস্তবেই রয়েছে। এখন প্রশ্ন—কর্তৃপক্ষ কখন জেগে উঠবে? দুর্ঘটনার পর, নাকি তার আগেই?

