“ছেলেটা আমার নিরীহ একটা ছেলে। সেই ছেলেকে ওরা ধরে নিয়ে গেলো!” এমনটাই বলছিলেন, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা অছিউর রহমান। সূত্র: বিবিসি
গত রোববার সন্ধ্যায় স্থানীয় একটি মুদি দোকানে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল মি. রহমানের সতেরো বছর বয়সী ছেলে মামুন। এমন সময় আকস্মিকভাবে দোকানটি ঘিরে ফেলে অস্ত্রধারী একদল ডাকাত।
“দোকানটা থেকে কাছেই পাহাড়ি জঙ্গল। মাগরিবের আজানের পরপরই ওই জঙ্গল থেকে আট থেকে দশজন লোক বের হয়ে এসে দোকান ঘিরে ফেলে। তাদের সবার হাতে অস্ত্র, মুখ ছিল কাপড় দিয়ে বাঁধা” বলেন মি. রহমান।
দোকানে ঢুকেই টাকা-পয়সা ও মালামাল লুট করে অস্ত্রধারীরা। এরপর যাওয়ার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত পাঁচ কিশোরের সবাইকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে জঙ্গলে ফিরে যায় ডাকাত দলটি।
যদিও ওই কিশোরদের মধ্যে একজন পরবর্তীতে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। কিন্তু দুইদিন পার হওয়ার পরও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি বাকি চারজনের।
“ছেলের চিন্তায় আমার স্ত্রী নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। দিন-রাত শুধু কান্না করতেছে” বলছিলেন মি. রহমান।
অপহরণের শিকার অন্য তিন কিশোরের পরিবারেও একই অবস্থা। যদিও এই ধরনের পরিস্থিতি এলাকাটির বাসিন্দাদের জন্য মোটেও নতুন কোনো অভিজ্ঞতা নয় বলে জানা যাচ্ছে।
“গত ছয় মাসে এখানে কমপক্ষে ত্রিশজনের মতো শিশু-কিশোর অপহরণের শিকার হয়েছে এবং প্রতিবারই মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে তাদেরকে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে” বলে জানায়, বাহারছড়ার আরেক বাসিন্দা রিয়াজুল হাসান খোকন।
এবারও একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।
“দুইদিন ধরে আমরা মোবাইলের দিকে তাকায় আছি। কত লাখ চায় কে জানে!” বলছিলেন অপহরণের শিকার আবু বক্কর ছিদ্দিকের বাবা মোহাম্মদ হাসান।
“দিন মজুরের কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাই। এর মধ্যে এত টাকা দিবো কিভাবে?” দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মি. হাসান।

বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে গত রোববার অপহরণের শিকার হওয়া পাঁচ কিশোরের মধ্যে একজন ডাকাত দলের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তার নাম মোহাম্মদ শাহীন।
অপহরণের ঘটনার ঘণ্টা দু’য়েক পর তেরো বছর বয়সী ওই কিশোর “হাঁপাতে হাঁপাতে” বাড়ি ফিরে আসে বলে জানান তার মা।
“সন্ধ্যায় ঘটনা জানার পর থেকেই তো বাড়িতে সবাই আমরা কান্না করতেছি। এর মধ্যে রাত আটটার দিকে দেখি আমার ছেলে ফিরে আসছে, হাঁপাতে হাঁপাতে। পথ দৌড়ে আসছে যে” বলে জানান, শাহীনের মা ফাতেমা বেগম।
কিন্তু সশস্ত্র ডাকাত দলের কাছ থেকে শাহীন পালাতে সক্ষম হলো কীভাবে?
“ও আমাকে যেটা বলেছে, সেটা হচ্ছে- অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটার সময় ওদের মধ্য থেকে দু’জন দৌড় দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। তাদের ধরার জন্য ডাকাতরাও পিছে পিছে দৌঁড় দেয়। ওই সুযোগে আমার ছেলেও পালিয়ে আসছে” বলেন মিজ বেগম।
পালানোর চেষ্টাকারী অন্য কিশোরদের ধরে ফেললেও ডাকাত দলটি শাহীনের ধরতে পারেনি।
“আসলে আমার ছেলেটা অন্য ছেলেগুলোর চেয়ে একটু ছোট। সেকারণে সে জঙ্গলের মধ্যে ডাকাতরা তাকে খুঁজে পায়নি” বলেন ফাতেমা বেগম।

পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় কক্সবাজারের টেকনাফে আগেও বিভিন্ন সময় ডাকাত দলের উৎপাত লক্ষ্য করা গেছে।
তবে সম্প্রতি লুট ও অপহরণের ঘটনা বেশি ঘটছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
“ইদানীং বেশি বাড়ছে। গত একবছরে টেকনাফে কম করে হলেও দুইশ’ মানুষ অপহরণের শিকার হয়েছে। আর ডাকাতি তো নিত্যদিনের ঘটনা” বলেন, বাহারছড়ার আরেক বাসিন্দা রিয়াজুল হাসান খোকন।
মি. খোকন বর্তমানে টেকনাফের বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।
অপহরণের যে হিসাব তিনি তুলে ধরেছেন, সেটি গণমাধ্যম ও স্থানীয় বাসিন্দাদের দেওয়া খবরের ভিত্তিতে প্রাপ্ত বলে দাবি করেছেন।
“এটা এখন এক আতঙ্কের জনপদ, সন্ধ্যার পর মানুষ ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে’ বলেন মি. খোকন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রশাসনের পক্ষ থেকে শক্ত আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই দিন দিন ডাকাতি ও অপহরণের ঘটনা বাড়ছে বলে ।
“একেকটা ঘটনা ঘটার পর তারা দুই-একবার আসে। এরপর আর কোনো খোঁজ থাকে না” বলছিলেন অপহরণের শিকার মামুনের বাবা অছিউর রহমান।
প্রতিকার চেয়ে বিভিন্ন সময় এলাকাবাসী বিক্ষোভ-আন্দোলন করেছে বলেও জানা যাচ্ছে।
“কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। সম্প্রতি যে ঘটনাটা ঘটলো, তাতে আবারো প্রমাণ হয়েছে যে, এখানে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নাই। সেজন্য এ সপ্তাহেই আমরা টেকনাফে রোডব্লক কর্মসূচির ডাক দিয়েছি” বলেন স্থানীয় বাসিন্দা ও উন্নয়নকর্মী মি. খোকন।

সাম্প্রতিক সময়ে টেকনাফে যে ডাকাতি ও অপহরণের খবর বেশি পাওয়া যাচ্ছে, পুলিশের স্থানীয় কর্মকর্তারাও সেটি স্বীকার করছেন।
“মূলত একপাশে সমুদ্র ও অন্যপাশে পাহাড় থাকার সুযোগ নিয়ে ডাকাতদের একাধিক দল এখানে সক্রিয় থাকায় ঘটনাগুলো ঘটছে” বলেন, কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জায়েদ নূর।
ডাকাতি ও অপহরণের এসব ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও জড়িত রয়েছে বলে জানাচ্ছেন এই কর্মকর্তা।
“ডাকাতি ও অপহরণের মামলায় অতীতে যেসব তদন্ত হয়েছে, সেখানে স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা শরণার্থী- উভয়ের জড়িত থাকার প্রমাণ আমরা পেয়েছি” বলেন মি. নূর।
ডাকাত দলগুলোর বিরুদ্ধে সেনা-পুলিশ-বিজিবি’র যৌথ অভিযান চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
কিন্তু তারপরও একের পর এক অপহরণের ঘটনা কেন ঘটছে?
“এখানে যেগুলোকে অপহরণ বলে দাবি করা হচ্ছে, সেগুলো সব আসলে সেই ধরনের অপহরণ নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাদক ব্যবসার সম্পর্ক রয়েছে” বলেন, ওসি মি. নূর।
আগের বিভিন্ন মামলা তদন্ত করতে গিয়ে সে ধরনের তথ্যই পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন তিনি।
“মাদকের টাকার ভাগাভাগি, দেনা-পাওনা- এমন নানান কারণে বেশিরভাগ ঘটনা ঘটছে। তবে এর মধ্যেও কিছু জেন্যুইন কেস আসছে” বলেন মি. নূর।
যদিও পুলিশের এমন দাবি মানতে নারাজ স্থানীয় বাসিন্দারা।
“আমরা বরং দেখছি, অল্পকিছু ঘটনার সঙ্গে মাদকের সম্পর্ক থাকতে পারে। বেশির ভাগই অপহরণের ঘটনা ঘটছে মুক্তিপণের জন্য” বলেন বাহারছড়ার আরেক বাসিন্দা রিয়াজুল হাসান খোকন।
এদিকে, একবছরে দুই শতাধিক অপহরণের ঘটনার যে তথ্য স্থানীয়রা দিয়েছেন, সেটির সঙ্গেও দ্বিমত পোষণ করছে পুলিশ। তবে প্রকৃত সংখ্যার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য কর্মকর্তারা দিতে পারেননি।
“ঘটনার পেছনের কাহিনী যা-ই হোক না কেন, অভিযোগ পেলেই পুলিশ সেগুলো তদন্ত করে দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে।
কিশোর অপহরণের যে ঘটনা সম্প্রতি ঘটেছে, তাদেরকে উদ্ধার করে অপরাধীদের গ্রেফতার করতে টাস্কফোর্স ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে” বলেন কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জায়েদ নূর।
সূত্র: বিবিসি

