আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব আবারও জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞ এবং ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারা দাবি করে আসছিলেন—এই গুরুত্বপূর্ণ পদে ইসির নিজের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে। তবু কমিশন শেষ পর্যন্ত সেই দাবি আমলে না নিয়ে আগের ব্যবস্থাই বজায় রাখছে।
ইসি সূত্র জানাচ্ছে, আগামী ১১ ডিসেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে। আর তফসিল অনুযায়ী ৮ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে যেকোনো একদিন ভোট হবে। রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের সিদ্ধান্তও একই দিন কমিশনের বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত করা হবে।
কেন ডিসিদের রাখা হচ্ছে—ইসির ব্যাখ্যা
নির্বাচন কমিশনের ভাষ্য, নিরাপত্তা, মাঠপর্যায়ের সমন্বয়ক্ষমতা এবং প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় ডিসিরা এই দায়িত্বে বেশি উপযোগী। তাই আগের মতোই ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কাজ করবেন—ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুজন বিভাগীয় কমিশনার এবং দেশের ৬৪ জেলার ডিসিরা। সহকারী রিটার্নিং অফিসার থাকবেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)।
ইসি কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন,
“রিটার্নিং অফিসার ও প্রিজাইডিং অফিসার—এই দুই পদই নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে তাদের ভূমিকাই মুখ্য। পরিস্থিতি বিচার করে বলা যায়, এবারের নির্বাচনেও ডিসিরাই এই দায়িত্ব পালন করবেন।”
ইসির কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি
অন্যদিকে, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা, বেশ কিছু রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন—ডিসিদের ওপর সরকারের প্রভাব থাকে, তাই তারা নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারেন না।
ইসির কর্মকর্তাদের মতে, নির্বাচন কমিশনের মধ্যেই যথেষ্ট দক্ষ কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও উপনির্বাচনে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের ভাষায়—স্থানীয় নির্বাচন পরিচালনার জটিলতা জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশি। তাহলে জাতীয় নির্বাচনেও দায়িত্ব দেওয়া হবে না কেন?
নির্বাচন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মনির হোসেন বলেন,
“৩০০ আসনে রিটার্নিং অফিসার দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত কর্মকর্তা ইসির আছে। তাই রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ইসির কর্মকর্তাদেরই দায়িত্ব দেওয়া উচিত।”
রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের অবস্থান
ইসির সংলাপে বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (কাঁঠাল প্রতীক) সহ একাধিক রাজনৈতিক দল একই দাবি তোলে—রিটার্নিং অফিসার পদ থেকে ডিসি ও ইউএনওকে সরিয়ে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে, যাতে প্রশাসনিক প্রভাব কমে।
এক সংলাপে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন,
“ইসি সাহস করে নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার করলে রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।”
সাবেক সরকারি কর্মকর্তারাও মনে করেন—ইসির দক্ষ কর্মকর্তাদের হাতে এই দায়িত্ব দিলে জবাবদিহি বাড়বে এবং কমিশন প্রয়োজনে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারবে, যেখানে ডিসিদের ক্ষেত্রে সেটা সবসময় সম্ভব হয় না।
তবু দু–একটি জেলায় পরিবর্তনের ইঙ্গিত
ইসি সূত্র বলছে, সব জেলায় না হলেও কয়েকটিতে ইসির আঞ্চলিক বা জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। দুজন নির্বাচন কমিশনার এর পক্ষে থাকলেও, বাকি দুজন মাঠপর্যায়ে সমন্বয়ক্ষমতার কারণে ডিসিদের বেশি যোগ্য মনে করেন। তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে একটি “মিশ্র মডেল”ও দেখা যেতে পারে।
আইন অনুযায়ী, রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে—সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সমাজের যেকোনো যোগ্য ব্যক্তিকেই এই পদে নিয়োগ দিতে পারে। স্থানীয় নির্বাচনে ইসির কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করলেও, জাতীয় নির্বাচনে বহু বছর ধরে ইসি ডিসিদের ওপরই নির্ভর করে আসছে।

