২০২৪ সালে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নানা দাবিতে মাঠে নামেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ডাক্তার, নার্স, সরকারি কর্মচারীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী। সরকারের পুরোটা সময় নানা দাবিতে সড়ক অবরোধ থেকে সচিবালয়ে ভেতরে ঢুকে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।
সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হয়েছে শিক্ষা খাতে। এর মধ্যে শুধু আদায় হয়েছে শিক্ষকদের ১৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়া আর ইবতেদায়ি মাদ্রাসার এমপিওভুক্তি।
অনুমোদনহীন জনসমাবেশ করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনী তপসিল হওয়ার পর সরকারের একমাত্র এবং মূল দায়িত্ব হলো নির্বাচন সংক্রান্ত কাজ। সরকার চাইলেও এর বাইরে কোনো দাবি-দাওয়া পূরণ করতে পারবে না। কারণ বদলি পদায়ন থেকে সরকারের নির্বাহী অনেক বিষয় চলে যাবে ইলেকশন কমিশনের (ইসি) হাতে। সরকার কারও দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়া এ মুহূর্তে সম্ভব নয়।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ অন্তত ৫টি গ্রুপ বিভিন্ন দাবিতে এখন মাঠে আছে। তাদের মধ্যে সাত কলেজ ইস্যুটি ছিল অন্যতম। তাদের আমরা বুঝিয়েছি নির্বাচনী তপশিল হলে সরকারের কিছু করার নেই। তারাও বুঝেছে এবং কর্মসূচি স্থগিত করেছে।
২০২৪ সালে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের অল্প সময়ে নজিরবিহীন সংখ্যক আন্দোলনের মুখে পড়েছে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের তথ্যমতে, সরকারের গত ছয় মাসে ১৩৬টিরও বেশি আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয়েছে। আর পুরো সরকারের সময় ধরলে সেই আন্দোলনের সংখ্যা ৪৫০ বেশি। এর মধ্যে বড় ও মাঝারি আন্দোলন ছিল ২২৫টি। যেগুলো সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। কোথাও বিভিন্ন বাহিনীর লাঠিপেটা, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট মারতে হয়েছে বেসরকারি শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া, প্রাথমিক শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে উন্নীত, মাদ্রাসার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি শিক্ষকদের সমাবেশে। এর মধ্যে টানা ১৭ বার আন্দোলন করে শুধু ১৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়ার দাবি আদায়ের সুফল পেয়েছেন বেসরকারি শিক্ষকরা। আর ইবতেদায়ি মাদ্রাসার দাবি মেনে নিলেও পূর্ণাঙ্গ দাবি বাস্তবায়ন হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোট ও বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক-কর্মচারী ফোরামের সভাপতি দেলওয়ার হোসেন আজেজী বলেন, পুরো আন্দোলনের সময় সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়েছি। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো বল প্রয়োগ করেনি। সর্বশেষ শিক্ষকদের টানা মাঠে থেকে আন্দোলন করায় আমরা বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত বিষয়ে সফলতা পেয়েছি।
আন্দোলনে করে দাবি আদায় হয়নি এমন একাধিক গ্রুপের নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যতটা আন্তরিক ছিল নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার ততটা আন্তরিক নাও হতে পারে। এজন্য আমরা চেয়েছি এই সময়টাকে বেছে নিতে। প্রাথমিক শিক্ষকদের একজন নেতা বলেন, আন্দোলন করলেই দাবি আদায় হয় এমন একটা বার্তা যখন পাওয়া গেল তখনই শিক্ষকরা আমাদের ওপর আন্দোলন করার চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ করতে না পারায় ১১তম গ্রেডসহ তিন দফা দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছি। এখন আমাদের দাবি মাঠে মারা গেল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উদ্বেগের বিষয় হলো, যারা দীর্ঘ সময় আন্দোলন করেছেন তাদের দাবিগুলো দীর্ঘদিনের জমানো। বিশেষ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে ধরে জমানো দাবি-দাওয়া নিয়ে এত আন্দোলন হলেও বেশিরভাগই কোনো কার্যকর ফল ছাড়াই মাঠে মারা যাচ্ছে।
সরকার বিভিন্ন দপ্তরের তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাব, সচিবালয়, শিক্ষাভবন, নীলক্ষেত-শাহবাগকেন্দ্রিক। আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৯০ শতাংশের বেশি আন্দোলন কোনো চূড়ান্ত সমাধান ছাড়াই স্তিমিত বা বন্ধ হয়ে গেছে।
পেশাজীবী ও কর্মচারীদের আন্দোলনে সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, আনসার, ডাক্তার, নার্স, রেলওয়ে কর্মচারী, বিসিএস বঞ্চিত কর্মকর্তারা বেশি। নার্সদের গ্রেড সংশোধন ও বেতন বৈষম্য নিরসনে রাজপথে দীর্ঘদিন আন্দোলন হয়েছে। বিএসসি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের পদমর্যাদা নিয়ে লম্বা সময় আন্দোলন হলেও বিষয়টি এখনো সুরাহা হয়নি।
গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে ঢাকা গাজীপুরের আন্দোলন হয়েছে। এ নিয়ে সংঘর্ষ-হামলা-মামলা হলেও সেই দাবি বাস্তবায়ন হয়নি।
এছাড়াও নবম পে-স্কেলের দাবিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সচিবালয়সহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে কর্মবিরতি বিক্ষোভ হলেও সেই পে-স্কেল পরবর্তী সরকারের জন্য রেখে গেলেন অর্থ উপদেষ্টা। যদিও গতকাল সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টাকে অবরুদ্ধ করে রাখেন কর্মচারীরা। ২০ শতাংশ ভাতার দাবিতে অবরুদ্ধ থাকেন তিন ঘণ্টা।
সরকার গঠনের পরপরই প্রথম আন্দোলন শুরু হয় সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে। এরপর বেসরকারি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত, শ্রমিক আন্দোলন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক, অন্যান্য শ্রমিক সংগঠন সড়ক, রেলপথে অবরোধ করেন। যদিও শ্রমিকদের আংশিক দাবি পূরণ হয়েছে। এই সময় আন্দোলন করেছে জুলাই গণহত্যার বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে। শেখ হাসিনার বিচারের দাবিতে রাজপথে ছিল আন্দোলন। তবে, তপশিলের পর আন্দোলন করলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ডিএমপি।
সূত্র: কালবেলা

