আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে, ঠিক ৫৪ বছর আগে, জাতি হারিয়েছিল তার সবচেয়ে উজ্জ্বল সন্তানদের। শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি, লেখক, শিল্পী—যাঁরা ছিলেন বাংলাদেশের চিন্তা ও সৃজনশীলতার মেরুদণ্ড। পরিকল্পিতভাবে তাঁদের হত্যা করা হয়েছিল। নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বাস্তবায়ন করেছিল তাদের স্থানীয় দোসররা।
পরে প্রকাশ্যে আসে ভয়াবহ তথ্য। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক হয়েছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর ও আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় নেতাদের। রাও ফরমান আলীর হাতেই ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকা। এই তালিকা তিনি তৈরি করেছিলেন আরও আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। উদ্দেশ্য ছিল একটাই—বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করা। তিনি জানতেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে পারলে একটি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া সম্ভব।
পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার হয়। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক ছিলেন। কেবল নাম বা বিভাগ নয়, বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও সেখানে লেখা ছিল। ঠান্ডা মাথায় তৈরি করা হয়েছিল পুরো পরিকল্পনা। জানা যায়, রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর বাবার তালিকাভুক্ত অনেক শিক্ষকেরই শিক্ষার্থী। তবু একজন পিতা হিসেবে রাও ফরমান আলীর বিবেক কাঁপেনি।
এই তালিকার বাইরেও হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল আরও আগে। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয় ১০ ডিসেম্বর। এসব ঘটনা আজ আমাদের ইতিহাসের অংশ। তালিকায় নাম ছিল জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো খ্যাতিমান শিক্ষকদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে যান।
এরপরের ঘটনাগুলো আরও ভয়াবহ। যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই ছিল সেই শিক্ষকদেরই ছাত্র। তারা বিদেশি সৈনিক ছিল না। তারা ছিল এই দেশের মানুষ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা চোখ বেঁধে নিয়েছিল এই আলোকিত মানুষদের। মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল, আবার ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু কেউই আর ফিরে আসেননি। বধ্যভূমিই হয়েছিল তাঁদের শেষ ঠিকানা।
শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের ঘটনা পারিবারিক সূত্রে জানা। তাঁকে তুলে নেওয়ার পর তাঁর পরিবার রাও ফরমান আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। আন্তরিকতার ভান করে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু সে আশ্বাস ছিল মিথ্যা। সেন্ট্রাল রোডের পৈতৃক বাসভবনে দুপুরে স্নান শেষে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। মা ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। ঠিক তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে ব্যক্তি তাঁকে নিতে এসেছিল, সে ছিল তাঁরই ছাত্র। পরিবারের আপত্তির জবাবে সে বলেছিল, অল্প সময়ের মধ্যেই স্যারকে ফিরিয়ে দেবে। সেই ভাত আর কোনো দিন খাওয়া হয়নি। মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন সেই বেদনা বয়ে বেড়িয়েছেন।
মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর ভাই জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। শেষ কথায় বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ স্বাধীনতা এসেছিল। কিন্তু তিনি তা দেখে যেতে পারেননি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে তিনটি মানুষের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। নির্মমভাবে নিহত সেই বুদ্ধিজীবীরা। তাঁদের সন্তানরা, যাঁদের অনেকের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে। আর হত্যাকারীরা, যারা এই অপরাধ করেও আজও অনেক ক্ষেত্রে দায়মুক্ত। মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা সবাই কিছু না কিছু হারিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই উজ্জ্বল মুখগুলো আর কোনো দিন দেখা যাবে না। প্রিয় লেখকদের নতুন লেখা আর পড়া হবে না। বহু শিল্পীর কণ্ঠ আর শোনা যাবে না।
পাকিস্তানি শাসকেরা ভুল করেনি মানুষ চিনতে। তারা জানত, শিক্ষা, শিল্প ও সাহিত্য ধ্বংস করতে হলে এই মানুষগুলোকেই আগে সরাতে হবে। তাই বেছে নিয়েছিল সেরা মানুষদের।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, এত শহীদের ভিড়ে কেন বারবার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথাই সামনে আসে। এর একটি প্রত্যক্ষ কারণ আছে। তাঁরা ছিলেন আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের পথপ্রদর্শক। তাঁদের চিন্তা ও দিকনির্দেশ আমাদের প্রভাবিত করেছে। আরেকটি পরোক্ষ কারণও আছে। আমরা সবাই একসঙ্গে লাখো শহীদের স্মৃতি বহন করতে পারি না। তাই প্রতীক খুঁজি। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা সেই প্রতীক।
একাত্তরের পর শিক্ষক হিসেবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনেক সন্তানের শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করার সুযোগ হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়ানোর সময় আশির দশকে তাঁদের কয়েকজনকে পেয়েছি। পরবর্তীতে পেয়েছি শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সন্তান তানভীর হায়দার চৌধুরী ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরীকে, শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণিকে এবং শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূরকে। এই সম্পর্ক আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি।
শিক্ষকতার বাইরেও অন্যভাবে কাছে পেয়েছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানদের। পরিচয় হয়েছে শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান মাহমুদার সঙ্গে। জেনেছি শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র মাহমুদকে। তখন মনে হয়েছে, যে শিশুরা একদিন বাবাকে হারিয়েছিল, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের কষ্ট আমরা পুরোপুরি বুঝব না। তবে এটুকু বুঝি, বিচারের দাবি তাদের মনে এখনো নীরবে কাঁদে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এটি শুধু ন্যায়বিচারের প্রশ্ন নয়। এটি মানবিকতার প্রশ্ন। শহীদদের আত্মার শান্তির প্রশ্ন। শহীদ-সন্তানদের অন্তরের দাবির প্রশ্ন। জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির প্রশ্ন। এই দায় রাষ্ট্রের, সমাজের এবং আমাদের সবার। এই দায় ভুলে গেলে চলবে না। এই দায় পূরণ করলেই জাতি হিসেবে আমাদের মুক্তি।

