ঢাকার ব্যস্ত রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলির শব্দ—এই দৃশ্য এখন আর কেবল অপরাধ সংবাদের অংশ নয়, বরং আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনীতির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে। ইনকিলাব মঞ্চের নেতা ও ঢাকা–৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদির ওপর গুলির ঘটনা তফসিল ঘোষণার ঠিক পরদিনই ঘটে যাওয়ায় পরিস্থিতির গুরুত্ব আরও বেড়েছে। এই এক ঘটনার মধ্য দিয়েই নির্বাচন-পূর্ব বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
ঘটনাটি শুধু একজন প্রার্থীর ওপর হামলা হিসেবে দেখা হচ্ছে না। রাজনৈতিক মহলে এটি দেখা হচ্ছে একটি ‘বার্তা’ হিসেবে—যেন বলা হচ্ছে, নির্বাচনের মাঠ নিরাপদ নয়। সে কারণেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে দ্রুত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই প্রকাশ্যে বলছেন, এ অবস্থায় প্রচারণায় নামা মানেই নিজের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলা।
আতঙ্ক থেকে অস্ত্রের লাইসেন্সের পথে
হাদির ওপর হামলার পর থেকেই একটি অস্বস্তিকর বাস্তবতা সামনে এসেছে—নিজেদের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থীরা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স চাইছেন। বিষয়টি নিজেই প্রমাণ করে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর কতটা আস্থা হারাচ্ছেন তারা। আগে যেখানে অস্ত্রের লাইসেন্স সীমিত কিছু পেশাজীবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা নির্বাচনী প্রার্থীদের জন্যও উন্মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ভাষায়, জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীরা চাইলে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাবেন। কিন্তু নাগরিক সমাজের অনেকের প্রশ্ন—এটি কি সমস্যার সমাধান, নাকি ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি? রাষ্ট্র যদি প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, তবে ব্যক্তিগত অস্ত্র কি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে পারে?
যমুনার বৈঠক ও ষড়যন্ত্রের ভাষা
এই ঘটনার পর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন। সেখানে তিনি হামলাটিকে ‘সিম্বলিক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, একটি সংগঠিত শক্তি পরিকল্পিতভাবে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে এবং তারা এখন প্রশিক্ষিত শুটার ব্যবহার করছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে জোরালো অভিযান, প্রার্থীদের চলাচলে নিরাপত্তা এবং অপরাধীদের দ্রুত বিচারের দাবি উঠে আসে আলোচনায়।
রাজনীতির ভেতরের ভাঙন, বাইরের সুযোগ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান সংকটের পেছনে শুধু অপরাধী চক্র নয়, রাজনৈতিক বিভক্তিও বড় ভূমিকা রাখছে। গত এক বছরে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিরোধ এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে পরাজিত ও ক্ষমতাচ্যুত শক্তিগুলো আবার সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, নির্বাচনে অংশ না নেওয়া বা নিষ্ক্রিয় থাকা শক্তিগুলো চাইবে ভোটের মাঠ অস্থিতিশীল করে তুলতে। আর এই সুযোগ তারা পাচ্ছে রাজনৈতিক ঐক্যের অভাব থেকেই। ফলে সহিংসতা, গুজব আর আতঙ্ক একে অন্যকে শক্তিশালী করছে।
ভোটারদের মনস্তত্ত্বে সবচেয়ে বড় আঘাত
এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ ভোটারদের মনে। একজন সম্ভাব্য প্রার্থী যদি প্রকাশ্যে গুলির শিকার হন, তাহলে সাধারণ মানুষ কীভাবে নিরাপদ বোধ করবেন? বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এমন ঘটনা চলতে থাকলে ভোটার উপস্থিতি মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। আর অংশগ্রহণহীন নির্বাচন মানেই প্রশ্নবিদ্ধ গণতন্ত্র।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। পুলিশি ব্যবস্থার পুনর্গঠন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বিত ভূমিকা ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়।
শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনা আসলে একটি সতর্ক সংকেত। এটি দেখিয়ে দিয়েছে, নির্বাচনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা এখন আইনশৃঙ্খলা আর রাজনৈতিক আস্থাহীনতা। সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলো যদি দ্রুত ও সমন্বিতভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারে, তাহলে ‘শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন’ কেবল ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
এখন প্রশ্ন একটাই—এই সতর্কবার্তা কি গুরুত্ব দিয়ে শোনা হবে, নাকি আরও বড় ঘটনার অপেক্ষা করতে হবে?

