দীর্ঘদিনের বিশৃঙ্খলা, দূষণ আর অনিরাপদ সেবায় জর্জরিত ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় অবশেষে বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় গঠিত হতে যাচ্ছে একটি পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ফান্ড , যার মাধ্যমে ঢাকায় ধাপে ধাপে নামানো হবে ৪০০টি বৈদ্যুতিক বাস।
বাংলাদেশ ক্লিন এয়ার প্রজেক্টের (ফেজ-১) আওতায় ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) এই তহবিল গঠন করবে। এর মূল লক্ষ্য—গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, বায়ুদূষণ কমানো এবং যাত্রীসেবার ন্যূনতম মান নিশ্চিত করা।
প্রকল্প নথি অনুযায়ী, এই পরিবহন তহবিলের মূল মূলধন ধরা হয়েছে ৪২৭ কোটি টাকা, এর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে যুক্ত হবে আরও ২৪৪ কোটি টাকার সিড ক্যাপিটাল।
এই ব্যবস্থায় বাসচালক বা অপারেটররা আর যাত্রী ভাড়া বা আয় নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকবেন না। সরকার ভাড়া নির্ধারণ ও রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব নেবে, আর অপারেটররা নির্দিষ্ট হারে সেবা প্রদানের জন্য নির্ধারিত ফি পাবেন।
নতুন ব্যবস্থায় ঢাকার সড়ক থেকে ধীরে ধীরে সরানো হবে পুরোনো ও দূষণকারী ডিজেল বাস। এ জন্য ৮৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখে একটি স্ক্র্যাপেজ ও ক্ষতিপূরণ কর্মসূচি চালু করা হবে। পুরোনো বাসের মালিকরা ক্ষতিপূরণ পেয়ে নতুন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন।
ডিটিসিএর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য শুধু বাস বদলানো নয়—বরং ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের সংস্কার বাস্তবায়ন।
ঢাকা বাস আধুনিকায়ন কর্মসূচির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১,২১৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১,১৮৩ কোটি টাকা আসবে বিশ্বব্যাংকের ঋণ থেকে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন থাকবে মাত্র ৩০ কোটি টাকা।
পুরো পরিবহন সংস্কার প্যাকেজের ব্যয় আরও বড়—প্রায় ২,৪৮২ কোটি টাকা, যার সিংহভাগই বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে।
প্রস্তাবটি ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
এই ব্যবস্থায় একটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান—অ্যাসেটকো বাসগুলো কিনবে এবং মালিকানায় রাখবে। বাসের রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যাটারি বদল, ওয়ারেন্টি—সবই তাদের দায়িত্বে থাকবে।
অন্যদিকে, ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিতে অপারেটররা ‘গ্রস কস্ট কন্ট্রাক্টে’ বাস চালাবে। এতে সম্পদের মালিকানা ও পরিচালনার দায়িত্ব আলাদা থাকায় জবাবদিহি বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রকল্পের আওতায় সরকারি জমিতে তিনটি ইলেকট্রিক বাস ডিপো উন্নয়ন করা হবে। সম্ভাব্য স্থান হিসেবে কাঁচপুর, গাবতলী, কল্যাণপুর, পূর্বাচল ও জোয়ার সাহারার কথা বিবেচনায় আছে।
ডিপো ও চার্জিং অবকাঠামো তৈরিতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৭৪৯ কোটি টাকা।
যাত্রী অভিজ্ঞতা উন্নত করতে চালু হবে ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম (ITS)। প্রায় ১৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে চালু হওয়া এই ব্যবস্থায় থাকবে—
-
বাস ট্র্যাকিং
-
ডিজিটাল টিকিট ও স্বয়ংক্রিয় ভাড়া আদায়
-
যাত্রী তথ্য ডিসপ্লে
-
কন্ট্রোল সেন্টার ও ডেটা সেন্টার
-
মোবাইল অ্যাপ
এই অ্যাপ দিয়ে যাত্রীরা সময়সূচি দেখা, টিকিট কেনা, যাত্রার সময় জানা, অভিযোগ দেওয়া—এমনকি যৌন হয়রানির ঘটনাও রিপোর্ট করতে পারবেন।
প্রায় ১৩৮ কোটি টাকার একটি সক্ষমতা উন্নয়ন কর্মসূচি রাখা হয়েছে, যার বড় অংশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে। ডিটিসিএর কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা, চুক্তি ব্যবস্থাপনা ও নজরদারিতে দক্ষ করে তোলা হবে।
চালক ও কন্ডাক্টরদের জন্য থাকবে সড়ক নিরাপত্তা, জ্বালানি দক্ষতা এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধ বিষয়ক প্রশিক্ষণ। নারী কর্মী বাড়াতে প্রণোদনার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
প্রকল্প নথিতে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে ঢাকার বাতাসে PM2.5-এর মাত্রা ছিল ৮৫ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার, যা বিশ্বমানের তুলনায় ভয়াবহ। শহরের প্রায় এক-চতুর্থাংশ দূষণের জন্য দায়ী পুরোনো, অরক্ষিত যানবাহন।
বর্তমান রুট-লাইসেন্স ভিত্তিক বাস ব্যবস্থায় অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা, বেপরোয়া চালনা ও অনিরাপদ সেবা নিয়মিত ঘটনা। প্রায় ৪ হাজার বাস লাভজনক রুটে গাদাগাদি করে চলে, অথচ অনেক এলাকা সেবা বঞ্চিত থাকে।
এই বিশৃঙ্খলা, দূষণ ও নিরাপত্তাহীনতা ঢাকাকে বিশ্বের অন্যতম বসবাস অযোগ্য শহরে পরিণত করেছে—বিশেষ করে নারী ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য।

