বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন করে অস্থিরতার ইঙ্গিত মিলছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে যারা আপসহীন অবস্থান নিয়েছেন, তারাই এখন ধারাবাহিকভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন।
বিশেষ করে ভারতের একতরফা নীতি ও প্রভাবের বিরুদ্ধে যারা রাজপথে এবং লেখালেখিতে সরব, তাদের নীরব করার একটি সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া চলছে বলে মনে করছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো।
এই আশঙ্কা আরও জোরালো হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের সংগঠক শরীফ ওসমান হাদির ওপর প্রকাশ্য দিবালোকে গুলিবর্ষণের ঘটনায়। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদের এই হামলা শুধু রাজপথ নয়, নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে কথা বলা ব্যক্তিরাই এখন একটি নির্দিষ্ট ‘হিটলিস্টে’ রয়েছেন।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, এই দমন কৌশল বহুমুখী। সরাসরি রাষ্ট্রীয় বাহিনী সামনে না রেখে ব্যবহার করা হচ্ছে ছায়া সংগঠন, ভাড়াটে ক্যাডার এবং ডিজিটাল ট্রল নেটওয়ার্ক। প্রথম ধাপে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টার্গেট ব্যক্তিদের ‘ভারতবিদ্বেষী’, ‘উগ্রবাদী’ বা ‘সাম্প্রদায়িক’ হিসেবে চিহ্নিত করে জনসমর্থন থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে তাদের গতিবিধি ও ব্যক্তিগত অবস্থান নজরদারিতে রাখা হয়। এরপর সুযোগ বুঝে শারীরিক হামলা অথবা ডিজিটাল পরিসর থেকে কার্যত সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে।
হাদির ওপর হামলার পর উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এটিকে ব্যক্তিগত ঘটনা হিসেবে দেখছেন না। তাদের মতে, এটি সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সোচ্চার কণ্ঠগুলোকে ভয় দেখানোর বৃহত্তর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ষড়যন্ত্রের অংশ। বিশ্লেষকদের মতে, ভারতীয় আধিপত্যবাদ এখন শুধু রাজনৈতিক পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়। সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এর প্রভাব বিস্তৃত। তিস্তা চুক্তি, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য ঘাটতি কিংবা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দিল্লির ভূমিকা নিয়ে যারা তথ্যভিত্তিক প্রশ্ন তোলেন, তারা সরাসরি শক্তিশালী স্বার্থগোষ্ঠীর মুখোমুখি হচ্ছেন।
গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, এই প্রেক্ষাপটে প্রায় ৫০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এখন সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। সরকারের উচ্চপর্যায়ের সম্মতির পর তাদের নিরাপত্তা জোরদারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তালিকার শীর্ষে আছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ সময় ধরে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান তাকে এই ঝুঁকির কেন্দ্রে এনেছে। একই তালিকায় আছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, যিনি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে নিয়মিত বক্তব্য দিয়ে আসছেন।
ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানও। ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে তার ভূমিকার কারণে তাকে ‘হাই রিস্ক’ হিসেবে চিহ্নিত করে সশস্ত্র নিরাপত্তা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ ও এবি পার্টির নেতা মুজিবুর রহমান মঞ্জু আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের প্রভাব নিয়ে কথা বলায় তারাও নজরদারিতে আছেন।
ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নেতারাও এই ঝুঁকির বাইরে নন। বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সঞ্জীব ভূঁইয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ায় টার্গেট হয়েছেন বলে মনে করছে গোয়েন্দারা। একইভাবে ছাত্রনেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমের জনপ্রিয়তা এবং সীমান্ত এলাকায় তাদের সফর ভারতীয় স্বার্থের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাদের সফরসূচি ফাঁসের পেছনে পরিকল্পিত তৎপরতা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ধর্মীয় অঙ্গনের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও তালিকায় রয়েছেন। হেফাজতে ইসলামের মাওলানা মামুনুল হক ও ইসলামী আন্দোলনের মুফতি রেজাউল করীমের জনভিত্তি এবং অবস্থান তাদের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। পাশাপাশি রয়েছেন মঞ্চ-২৪-এর ইকরামূল হাসান ফাহিম, আপ বাংলাদেশের আলী আহসান জুনায়েদ এবং ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম।
বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক অস্থিরতার আশঙ্কা করছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। অভিযোগ রয়েছে, ক্যাম্পাসে কিছু স্লিপার সেল সক্রিয় রয়েছে যারা ভারতবিরোধী অবস্থান নেওয়া ছাত্রনেতাদের গতিবিধি নজরে রাখছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন ছাত্রনেতা গোপন ফোনে প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ করেছেন।
ডিজিটাল পরিসরেও উদ্বেগজনক চিত্র সামনে এসেছে। সাইবার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু সংগঠিত গ্রুপ নিয়মিতভাবে আধিপত্যবিরোধী ব্যক্তিদের ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। ডার্ক ওয়েবে ফোন নম্বর ও অবস্থান শেয়ারের প্রমাণও পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা একে পরিকল্পিত মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ হিসেবে দেখছেন, যার লক্ষ্য ভয় সৃষ্টি করে কণ্ঠরোধ করা।
নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য সশস্ত্র এসকর্ট, সেফ হাউস এবং সমন্বিত নজরদারি সেল গঠন করা হয়েছে। জনসভা ও ভ্রমণের আগে সংশ্লিষ্ট এলাকা তল্লাশি করে নিরাপত্তা বেষ্টনী নিশ্চিত করা হচ্ছে।
হাদির ওপর হামলার ঘটনায় হামলাকারী হিসেবে ফয়সাল করিম মাসুদকে চিহ্নিত করা হলেও এর পেছনে বৃহত্তর আঞ্চলিক যোগসূত্র আছে কি না, সে তদন্ত এখনো স্পষ্ট নয়। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের একটি অংশ মনে করছে, এটি ছিল একটি ‘টেস্ট কেস’। উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া পরখ করা।
নিরাপত্তা মহলের মতে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক হতে হবে সমমর্যাদার। সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কণ্ঠ তোলাকে ‘বিদ্বেষ’ আখ্যা দিয়ে দমন করার চেষ্টা দেশকে বিপজ্জনক পথে ঠেলে দিতে পারে। তারা সতর্ক করছেন, এই নীরব সন্ত্রাস ঠেকাতে জাতীয় ঐক্য, স্বচ্ছতা এবং মতপ্রকাশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। তা না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।

