নির্বাচনী ট্রেন দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। দেশের মানুষের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অর্থনীতিকে সচল করা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ইতিহাস গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও জানিয়েছিলেন, ১৮ মাসের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সেনাবাহিনী জানিয়েছে, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটে তারা সব ধরনের সহায়তা দেবে এবং নির্বাচন শেষে ব্যারাকে ফিরে যাবে।
নির্বাচন কমিশন দ্রুতগতিতে প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে। প্রশাসন নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী চূড়ান্ত, জোটগত আসন ভাগাভাগি ও প্রচারণায় ব্যস্ত। সারা দেশে সভা-সমাবেশ ও উঠান বৈঠক চলছে। ভোটাররাও দীর্ঘদিন পর ভোট দেয়ার অপেক্ষায়। প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের ঘোষিত সময়সূচি ঘিরে দৃঢ় অবস্থান থাকলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের শঙ্কা, পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা হতে পারে কি না।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ভারতকে ঘিরে একাধিক উত্তেজনাকর ঘটনা সামনে এসেছে। ইনকিলাব মঞ্চের ওসমান হাদিকে হত্যা, সেভেন সিস্টার্স ইস্যু সামনে আনা, ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাওয়ের হুমকি এবং আইনশৃঙ্খলা অবনতির প্রচারণা—এসব ঘটনাকে অনেকেই দেখছেন নির্বাচনী পরিবেশ ঘোলাটে করার কৌশল হিসেবে। সম্ভাব্য কয়েকজন প্রার্থীর নিরাপত্তা চেয়ে নির্বাচন কমিশনে আবেদনও আলোচনায় এসেছে।
এদিকে সরকার ঢাকায় কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকদের নির্বাচনের প্রস্তুতি ও সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ করেছে। জানানো হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। বিদেশি দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। নির্বাচন কমিশন বিদেশি পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানিয়ে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানিয়েছে। নির্বাচন বানচালের অভিযোগে সহিংসতার ঘটনায় জড়িতদের দমনে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ও শুরু হয়েছে।
নির্বাচনী মাঠে সব দলের প্রার্থীরা ঘরে ঘরে যাচ্ছেন। প্রচারণা চলছে স্বাভাবিক গতিতে। এমন বাস্তবতায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফেরার ঘোষণা রাজনীতিতে নতুন গতি এনেছে। ১৭ বছরের প্রবাসজীবন শেষে তার দেশে ফেরাকে ঘিরে জনমনে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমান দেশে ফিরলে রাজনৈতিক সমীকরণ দ্রুত বদলে যেতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে হঠাৎ ভারত-বিরোধিতার নামে উত্তেজনা সৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের মতে, এতে দিল্লির কাছে ‘বাংলাদেশে উগ্রবাদ আছে’—এমন অভিযোগ জোরালো করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমানের মতে, যারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারবে না এবং নির্বাচন পেছাতে চায়, তারাই ভারত-বিরোধিতাকে পুঁজি করে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে। অতীতে যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে সুবিধা নেয়া হয়েছে, এখন তেমনিভাবে নতুন স্লোগান ব্যবহার করে প্রশাসনিক প্রভাব ধরে রাখার চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পর দেশের মানুষ এবার সত্যিকারের ভোটের অপেক্ষায়। নির্বাচিত সরকার না থাকায় বিনিয়োগ কমেছে, অর্থনীতি চাপে পড়েছে, বেকারত্ব বেড়েছে। অনেকের বিশ্বাস, নির্বাচন হলেই অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। সে কারণেই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছেন।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ও বাইরে এমন কিছু শক্তির অস্তিত্ব নিয়েও আলোচনা চলছে, যারা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতার স্বপ্ন দেখছে। নির্বাচন হলে তাদের প্রভাব কমে যাবে—এমন আশঙ্কা থেকেই নানা ইস্যু উসকে দেয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ভারত-বিরোধিতার নামে অস্থিরতা তৈরি করে ‘দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই’—এমন বার্তা ছড়ানোর ঝুঁকিও দেখছেন তারা।
সব মিলিয়ে রাজনীতির মাঠে প্রশ্ন একটাই—ঘোষিত সময়েই কি নির্বাচন হবে, নাকি পরিকল্পিত উত্তেজনা সেই যাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়াবে? দেশের মানুষ এখন তাকিয়ে আছে একটি উৎসবমুখর, শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের দিকে।

