অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ টু’ অভিযান শুরু হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর। ওই দিনে দেশের ৬৩৯টি থানার এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় ৫৬৭ জনকে। অর্থাৎ, গড়ে প্রতি থানা এলাকা থেকে একজনেরও বেশি গ্রেফতার হয়নি। পরবর্তী দিনগুলোরও গড় গ্রেফতার এক হাজারের বেশি হয়নি। সাধারণ অভিযানেই যেখানে হাজারের বেশি গ্রেফতার হয়, সেখানে এই সংখ্যাটা তুলনামূলকভাবে কম।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশ এখনও সম্পূর্ণভাবে অভিযানমুখী হতে পারেনি। এজন্য বিশেষ অভিযান হলেও গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধার সাধারণ অভিযান থেকে কম হয়েছে। ফলে মব, হত্যাসহ নানা ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
দেশজুড়ে ৬৩৯টি থানার মাধ্যমে পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করে। পাশাপাশি র্যাব ও বিজিবি গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করে। ১৩ ডিসেম্বর ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করার পরদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোর কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, দেশজুড়ে শুরু হবে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ টু’। সেই রাতেই পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে বিশেষ অভিযান শুরু করে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) একই দিন বিকাল থেকে রাজধানীতে চেকপোস্ট জোরদার করার ঘোষণা দেয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ টু’ শুরু হয় ১৩ ডিসেম্বর রাত থেকে। প্রথম দিনে গ্রেফতার করা হয় ৪৭৬ জনকে। এ সময় উদ্ধার করা হয় চারটি দেশী-বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র, দুটি বিস্ফোরক ও একটি ধারালো চাকু। অভিযানের দ্বিতীয় দিনে, ১৪ ডিসেম্বর, গ্রেফতার করা হয় ৫৬৭ জনকে। অস্ত্র হিসেবে উদ্ধার করা হয় একটি দেশী বন্দুক ও তিনটি চাকু। পরের দিন ১৫ ডিসেম্বর গ্রেফতার সংখ্যা বেড়ে ৮২৩ জন হয়। এদিন উদ্ধার করা হয় চারটি দেশী-বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র, ১২ রাউন্ড গুলি ও দুটি ধারালো অস্ত্র।
১৬ ডিসেম্বর সারা দেশে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় ৯৬৮ জনকে। উদ্ধার করা হয় পাঁচটি অগ্নেয়াস্ত্র, পাঁচ রাউন্ড গুলি ও ১৪টি ধারালো অস্ত্র। ১৭ ডিসেম্বরও গ্রেফতার সংখ্যা ৯৬৮ জনই থাকে। এদিনও পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র, পাঁচ রাউন্ড গুলি ও ১৪টি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এই পাঁচদিনে সাধারণ অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে মোট ৪ হাজার ৯৬ জনকে।
ডেভিল হান্ট ও ডেভিল হান্ট ফেজ টু অভিযানে সরাসরি অংশ নেওয়া এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘বিগত যেকোনো বিশেষ অভিযানে দৈনিক গড় গ্রেফতার ছিল প্রায় পাঁচ হাজার। তুলনায় ডেভিল হান্ট ও ফেজ টু’তে দৈনিক গড় গ্রেফতার সর্বোচ্চ এক হাজার।’
তিনি আরও জানান, ‘সারা দেশে ৬৩৯টি থানা অভিযানে অংশ নেয়। প্রতিটি থানা পাঁচজন করে অপরাধী চিহ্নিত করে গ্রেফতার করলে সংখ্যা দাঁড়াত ৩ হাজার ১৯৫। স্পষ্ট বোঝা যায়, পুলিশ এখনও পুরোপুরি অভিযানমুখী নয়। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে বড় ধরনের অভিযান নেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে কোটা পূরণের জন্য শুধু দু-একজনকে গ্রেফতার করে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘অপারেশন ডেভিল হান্টের প্রথম পর্যায়ে অভিযোগের ভিত্তিতে অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু অনেক অভিযুক্তকে গ্রেফতারের পরও আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে বাহিনীগুলোকে বেশ কষ্ট পেতে হচ্ছে। এরই মধ্যে নির্বাচনকে ঘিরে প্রার্থীদের হত্যার চেষ্টাও হয়েছে কয়েক দফা। মূলত নাগরিক নিরাপত্তায় যে ঝুঁকি থাকে, সেটা এ ধরনের অভিযানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।’
তিনি আরও জানান, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করা এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরিচালিত অভিযানকেই বিশেষ অভিযান বলা হয়। তবে এর ফলাফল নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্ন থাকে। অভিযান যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে কি না, প্রকৃতপক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না—এসব নিয়ে সন্দেহ থাকে। সব পুলিশ সদস্যকে অভিযানমুখী করতে পারছি কি না, সেটিও দেখতে হবে। বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মবের শিকার হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধান করা প্রয়োজন।’
এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর পাওয়া যাওয়ার পর শুক্রবার ভোর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কড়াকড়ি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মাঠে মোতায়েন করা হয়েছে সাদা পোশাকের পুলিশ। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় র্যাব ও পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি সদস্যরাও দায়িত্বে আছেন। পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম বিভিন্ন এলাকায় পরিদর্শন করেন।
হাদির মৃত্যুর খবর সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ওই রাতেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। এতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার এর কার্যালয়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর, ছায়ানটের অফিসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লক্ষ্য হয়। হামলাকারীরা বিভিন্ন স্থানে লুটপাটও চালায়। এরপরই নড়েচড়ে বসেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে হামলাকারীদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে পাঠানো হয় সিআইডির ফরেনসিক দল। বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাব ও সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিট কাজ শুরু করেছে।
পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, বেশির ভাগ হামলাকারীকে আগেও বিভিন্ন ধরনের মব সৃষ্টিতে দেখা গেছে। এ ঘটনায় বিএনপি, এনসিপি, জামায়াত ও ইনকিলাব মঞ্চ দ্রুত নিন্দা জানিয়ে এই ধরনের কর্মকাণ্ড এড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে।
এবার প্রশ্ন উঠেছে, হামলাকারীরা আসলে কার অনুসারী এবং তারা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে মাঠে নেমেছে কিনা। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে অন্তত দেড় শতাধিক ব্যক্তি শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেককে বিভিন্ন সময় কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা গেছে। ঘুরেফিরে এরা বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর ও হামলা চালাচ্ছে। এখন সরকার চাইলে তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন বলেন, ‘অপারেশন ডেভিল হান্টে যেমন গ্রেফতার হয়েছে, ডেভিল হান্ট ফেজ টুতেও দৈনিক প্রায় এক হাজার করে গ্রেফতার হচ্ছে। পাশাপাশি অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরকও উদ্ধার করা হচ্ছে। ডেভিল হান্ট ফেজ টু অভিযানে দেখা যাচ্ছে অপরাধীরা গা ঢাকা দিয়েছে। এর পরেও তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গ্রেফতার সংখ্যা সবসময় কিছুটা ওঠানামা করে। নির্বাচনের কারণে প্রার্থীদের মধ্যে কিছু দ্বন্দ্বও ঘটছে। সব মিলিয়ে পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে শতভাগ পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করছে।’

