ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলা হলেও বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ এখনো ইন্টারনেটের বাইরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে উঠে এসেছে এই উদ্বেগজনক বাস্তবতা। জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি ৯৮ লাখ হলেও ইন্টারনেট ব্যবহার করেন মাত্র ৮ কোটি ৩০ লাখের কিছু বেশি মানুষ। অর্থাৎ প্রায় ৮ কোটি ৭০ লাখ নাগরিক এখনো কার্যত ডিজিটাল সংযোগহীন জীবন যাপন করছেন।
ইন্টারনেটের বাইরে থাকা এই বিশাল জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের ডিজিটাল সেবা, অনলাইন তথ্যপ্রাপ্তি এবং প্রযুক্তিনির্ভর সুযোগ-সুবিধা থেকে সরাসরি বঞ্চিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক দশকে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনভিত্তিক সেবার দ্রুত সম্প্রসারণ হলেও উচ্চ কর ও মোবাইল ডেটার অতিরিক্ত খরচ সাধারণ মানুষের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিবিএস প্রতি তিন মাস অন্তর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে জরিপ চালায়। সর্বশেষ জরিপটি করা হয়েছে চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়কালে। এতে দেশের ৬১ হাজার ৬৩২টি পরিবারের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন পাঁচ বছর বা তার বেশি বয়সী নাগরিকরা।
গত এক দশকে সরকার ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক বিস্তার, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। কিন্তু বিবিএসের তথ্য বলছে, এই অবকাঠামোর সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পুরোপুরি পৌঁছায়নি। বর্তমানে দেশে ব্যক্তিগতভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন মাত্র ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ।
জরিপে উঠে এসেছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা। দেশে যেখানে ৮১ শতাংশ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, সেখানে নিজের নামে মোবাইল সেটের মালিকানা রয়েছে মাত্র ৫৭ শতাংশ মানুষের। অর্থাৎ প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ অন্যের ফোনের ওপর নির্ভর করে যোগাযোগ ও ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।
এই নির্ভরশীলতা ব্যক্তিগতভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারে বড় সীমাবদ্ধতা তৈরি করছে। বিশ্লেষকদের মতে, অনেক পরিবারে এক বা দুটি ফোন থাকলেও ব্যবহারকারী একাধিক হওয়ায় নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থাকে না। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে শিক্ষার্থী, নারী ও বয়স্ক নাগরিকদের ওপর।
ইন্টারনেট ব্যবহারে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জরিপে। পুরুষদের মধ্যে যেখানে ৫১ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, সেখানে নারীদের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ৪৬ শতাংশের কিছু বেশি। প্রযুক্তিবিদদের মতে, এটি কেবল একটি পরিসংখ্যানগত পার্থক্য নয়—বরং নারীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পথে একটি কাঠামোগত বাধা।
গ্রামাঞ্চল ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর অবস্থাও খুব একটা ভিন্ন নয়। মোবাইল ডেটার উচ্চমূল্য, স্মার্টফোনের নাগালের বাইরে থাকা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব তাদেরকে ইন্টারনেট সুবিধা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর হার ছিল ৩৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২৫ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশে। তিন বছরে প্রায় ১০ শতাংশ পয়েন্ট অগ্রগতি হলেও বাস্তবতা হলো—এই অগ্রগতি সবার জন্য সমান নয়। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু সেই অগ্রযাত্রা এখনো বৈষম্যপূর্ণ ও অসম।

