৩৮ বছর বয়সী মিঠু ইসলাম। রাজশাহীর মোহনপুরে অপমৃত্যুতে নিহতদের মরদেহ বহনই মিঠু ইসলামের জীবিকা। থানার কোনো বেতন না পেয়ে তিনি নিহতের স্বজনদের কাছ থেকেই পারিশ্রমিক নেন। নয় বছরে ৮০টির বেশি মরদেহ বহন করলেও ভয় নয়, পেটের দায়েই মৃত্যুর সঙ্গেই তার নিত্যদিনের সহচর্য।
মিঠু ইসলাম রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার আমড়াইল গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা বিরাত আলী। নাপিতের পেশা ছেড়ে ২০১৬ সালে ওস্তাদ মোস্তাফার হাত ধরে মরদেহ বহনের কাজে যুক্ত হন তিনি। এরপর থেকেই মৃত্যুর সঙ্গে নিত্যদিনের সহচর্যে তার জীবন।
গত ১৭ ডিসেম্বর রাত ৯টার দিকে মোহনপুর উপজেলার ধুরইল ইউনিয়নের বড় পালশা গ্রামে পুকুর খননের কাজে ব্যবহৃত একটি ভেকু গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যান আহামেদ জুবায়ের (২৫)। ওই রাতেই মোহনপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে জুবায়েরের মরদেহ থানায় নিয়ে আসেন মিঠু ইসলাম। সারা রাত থানার ভেতরেই পড়ে ছিল মরদেহটি। পাশেই বসে নির্ঘুম রাত কাটান মিঠু ও তার সহযোগী হাবিল। হাবিলের জন্য এটি ছিল মরদেহ বহনের কাজে প্রথম অভিজ্ঞতা।
পরদিন ১৮ ডিসেম্বর সকালে মোহনপুর থানায় গিয়ে দেখা যায়, মরদেহের পাশেই বসে আছেন মিঠু ও তার সহযোগী। তখন কথা হয় মিঠুর সঙ্গে। তিনি জানান, প্রায় নয় বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত আছেন এবং এ পর্যন্ত ৮০ থেকে ৮৫টি মরদেহ বহন করেছেন।
মিঠু বলেন, থানার পক্ষ থেকে কোনো পারিশ্রমিক না পাওয়ায় নিহতের স্বজনদের কাছ থেকেই টাকা নিতে হয়। ঘটনাস্থল কিংবা হাসপাতাল থেকে মরদেহ থানায় আনা, ময়নাতদন্ত শেষে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া—এই পুরো প্রক্রিয়াতেই তিনি উপস্থিত থাকেন।
তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে এই কাজ শুরু করি। আগে সেলুনে নাপিতের কাজ করতাম। কখনও অটোরিকশা বা ভ্যান চালাতাম। ওস্তাদ মোস্তফার হাত ধরে এই কাজে আসি। আমার কাজ শুধু মোহনপুর থানা এলাকায়। অপমৃত্যু হলে থানা থেকে ফোন দেয়—বডি আছে, নিয়ে আসো। তখন লাশের কভার নিয়ে ঘটনাস্থলে যাই। তুলে এনে থানায় রাখি। পরে ময়নাতদন্ত শেষে বাড়িতে পৌঁছে দিই।’
ভয় লাগে কি না জানতে চাইলে মিঠু বলেন, ‘ভয়টা মনের ধান্দা। মনে ভয় করলে ভয়, মনে জয় করলে জয়। আল্লাহর রহমতে কোনোদিন ভয় করিনি। ভবিষ্যতেও যেন ভয় না আসে সেই দোয়া করি।’
পারিশ্রমিক প্রসঙ্গে তিনি জানান, কাজ ও পরিবারের অবস্থার ওপর নির্ভর করে টাকা নেন। গরিব হলে কম নেন, অনেক সময় খাবার খেয়েই কাজ করেন। সাধারণত অসহায় পরিবার চার হাজার টাকা দেয়, অন্যদের কাছ থেকে পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা নেওয়া হয়।
পরিবারের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে মিঠু বলেন, পেটের দায়েই এই পেশায় আসতে হয়েছে। তার এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। স্ত্রী একাই বাড়িতে থাকেন। থানায় কোনো বেতন না থাকলেও পরিশ্রম করে যা পান তাই দিয়েই সংসার চলে।
তিনি জানান, বাড়িতে ফেরার সময় সতর্কতা মেনে চলেন। গোসল না করে ঘরে ঢোকেন না। স্ত্রীকে আগেই ফোন করে পুকুরে কাপড় নিয়ে আসতে বলেন।
ধর্মীয় পবিত্রতা নিয়ে কোনো জটিলতা নেই জানিয়ে মিঠু বলেন, ‘আমরা নাপাক অবস্থায় থাকি না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকি। মন পাক থাকলে দেহও পাক থাকে।’
রাত-বিরাতে মরদেহ পরিবহন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঝুলন্ত মরদেহ বা বিকৃত লাশ দেখলেও ভয় লাগে না। ‘লাশ কথা বলে না। শরীর একটা খাঁচা, পাখি উড়ে গেলে খাঁচা পড়ে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘রাত ৩টার সময় একা একা লাশ নিয়ে থানায় এসেছি। ভয় পাই না। এই যে লাশ দেখতাছেন—আমি নিজেও লাশ। আমি জিন্দা লাশ হয়ে লাশ নিয়ে আসি। লাশ ছুঁতে ভয় কীসের?’
তবে শিশু বা তরুণদের মরদেহ দেখলে কষ্ট হয় জানিয়ে তিনি বলেন, মেয়ের বা বোনের বয়সী হলে ভেতরে ভেঙে পড়েন।
নিজের পেশা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি ডোম না। ওস্তাদ মোস্তফা আমাকে এই কাজে লাগান। এখন তিনি আর পারেন না। আমি করছি। আমার সঙ্গে হাবিল আছে। তার প্রথম কাজ জুবায়েরের মরদেহ বহন।’
এ বিষয়ে মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসএম মঈনুদ্দীন বলেন, অপমৃত্যুর ঘটনায় মরদেহ পরিবহন ও ময়নাতদন্ত শেষে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি মিঠু করেন। থানার পক্ষ থেকে তাকে কোনো বেতন দেওয়া হয় না। নিহতের স্বজনদের কাছ থেকে তিনি পারিশ্রমিক নেন।
রাজশাহীর মোহনপুরে অপমৃত্যুতে নিহতদের মরদেহ বহনই মিঠু ইসলামের জীবিকা। থানার কোনো বেতন না পেয়ে তিনি নিহতের স্বজনদের কাছ থেকেই পারিশ্রমিক নেন। নয় বছরে ৮০টির বেশি মরদেহ বহন করলেও ভয় নয়, পেটের দায়েই মৃত্যুর সঙ্গেই তার নিত্যদিনের সহচর্য। সূত্র: ঢাকা পোস্ট

