গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের মোট বাঁশবাগানের ৮০ শতাংশের বেশি হারিয়েছে। পরিবেশবিদ ও বন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রকৃতির পুনরুদ্ধার সক্ষমতার তুলনায় অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত উজাড়ের কারণে বাঁশবাগান আশঙ্কাজনকভাবে কমছে।
একসময় দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা বাঁশবাগান এখন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, যা গভীর উদ্বেগের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বসতি সম্প্রসারণ এবং দীর্ঘদিনের বন উজাড়ের ফলে দেশের বাঁশসম্পদ ধীরে ধীরে কমছিল। তবে প্রকৃত পরিবর্তন আসে ২০১৭ সালে, যখন মিয়ানমার থেকে ব্যাপক সহিংসতার কারণে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর আবাসন মূলত বাঁশের তৈরি ঘরের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়। ফলে হঠাৎ করে দেশে বাঁশের চাহিদা বেড়ে যায়। বর্তমানে প্রতি বছর অন্তত দুই কোটি বাঁশের অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হচ্ছে, যা দেশের বাঁশবাগানের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আকতার হোসেন জানান, “শরণার্থী শিবিরে বাসা-বাড়ি, রাস্তা, সেতু, মেডিকেল ও সার্ভিস সেন্টার সবকিছুই বাঁশের ওপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর শিবিরে ২ কোটি বাঁশ প্রয়োজন হয়। চট্টগ্রাম–কক্সবাজার অঞ্চলের প্রায় সব বাঁশ শেষ হয়ে গেছে। এখন উত্তরবঙ্গ থেকে বাঁশ আনা হচ্ছে।”
প্রতিবছর শরণার্থী শিবিরের বাড়তি চাহিদার কারণে বনাঞ্চল থেকে ব্যাপকভাবে বাঁশ কাটা হয়। চট্টগ্রাম-বিএফআরআই-এর জরিপ অনুযায়ী, ২০০৫ সালে দেশে বাঁশবাগানের আয়তন ছিল ৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। ২০১৬–১৭ সালে তা নেমে আসে ৫ লাখ হেক্টরে এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালে মাত্র ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬১৯ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। কক্সবাজার জেলায় প্রায় ৬০০ একর এলাকায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ায় বনাঞ্চল এবং বাঁশবাগানও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শিবিরে ব্যবহৃত বাঁশের মধ্যে প্রধান দুটি প্রজাতি হলো মুলি বাঁশ ও বরাক বাঁশ। মুলি বাঁশ মূলত ছাউনি তৈরিতে ব্যবহার হয়, বরাক বাঁশ কাঠামোগত নির্মাণে ব্যবহারের জন্য সোজা ও শক্ত হওয়ায় বেশি চাহিদাসম্পন্ন। দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে ট্রাকের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পরিবহন করা হয়, যেখানে একটি বরাক বাঁশ পরিবহন খরচ প্রায় ৩২০ টাকা।
গবেষকরা জানাচ্ছেন, সাধারণ বাঁশের স্থায়িত্ব মাত্র এক থেকে দুই বছর। তবে ট্রিটমেন্ট করলে তা ১০–১৫ বছর পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য হয়। কিন্তু দেশে পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট সুবিধা না থাকায় বাঁশের ব্যাপক অপচয় হচ্ছে। অধ্যাপক ড. আকতার হোসেনের মতে, প্রতি বছর শিবিরে ব্যবহৃত দুই কোটি বাঁশের মাত্র ৫ শতাংশ ট্রিটমেন্ট করা হয়, যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
বাঁশ সংরক্ষণ ও চাষ সম্প্রসারণের জন্য ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামে বেসরকারি এবং সরকারি উদ্যোগে সৈয়দ মুর্তজা হাসান ব্যাম্বু সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে সেখানে ৩৭ প্রজাতির বাঁশ সংরক্ষিত রয়েছে, যা চারা উৎপাদন, বীজ সংরক্ষণ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, মানবিক প্রয়োজন, অর্থনৈতিক চাপ এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে বর্তমান হারেই বাঁশ আহরণ চলতে থাকলে দেশের বাঁশভিত্তিক প্রতিবেশব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশের বাঁশবাগান শুধুমাত্র সরবরাহ সংকট নয়, বরং পরিবেশগত সংকটে রূপ নিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে গ্রামীণ জীবিকা, জলবায়ু সহনশীলতা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধি বিপন্ন হবে।

