নদীর নাম পানগুছি। দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে চলা এই নদী একসময় ছিল এ জনপদের প্রাণ। পানগুছির জল ভেঙে সওদাগরি নৌকা ভিড়ত মোরেলগঞ্জের মোহনায়, আর সেই নদীকেন্দ্রিক বাণিজ্য ও যাতায়াতেই গড়ে ওঠে এই গঞ্জ। সময়ের পরিক্রমায় সেই চিত্র আজ সম্পূর্ণ বদলে গেছে।
নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন এবং লবণাক্ত পানির আগ্রাসনে মোরেলগঞ্জের হাজারো পরিবার আজ ঘরছাড়া। ভিটেমাটি হারিয়ে বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছেন। যারা এখনো এলাকায় রয়ে গেছেন, তাদের জীবন হয়ে উঠেছে চরম অনিশ্চয়তা ও কষ্টে ভরা।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা সদর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের গাবতলা গ্রামে গিয়ে কথা হয় ‘মা সংসদ’-এর মমতাজ বেগম, ‘স্বাস্থ্যগ্রাম’ দলের জান্নাতুল বুশরা, নূর জাহান বেগম, গফফার তালুকদার, সাবেক ইউপি সদস্য মো. নুরুল ইসলাম, আল আমিন মিরাজ, মো. আলি বিশ্বাসসহ আরো অনেকের সঙ্গে। তারা জানান, পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা সমস্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ দেখা যায় না। প্রায় প্রতিবারই বাজেট স্বল্পতার অজুহাত তুলে ধরা হয়।
এলাকাবাসীর ভাষ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তাদের দৈনন্দিন জীবনকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙনের পাশাপাশি জোয়ারের লবণাক্ত পানি নিয়মিত জনপদে ঢুকে পড়ছে। এতে নিরাপদ পানির সংকটের পাশাপাশি ফসলি জমি, নারিকেল ও সুপারির বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানও চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে স্থানীয় অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, দারিদ্র্য বাড়ছে এবং জীবিকার তাগিদে অনেক মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।
এলাকাবাসীর প্রধান দাবির মধ্যে রয়েছে লবণাক্ত পানির আগ্রাসন ঠেকাতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নিরাপদ পানির স্থায়ী ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং জলবায়ু সহনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি। তাদের মতে, এসব দাবি বাস্তবায়ন করা গেলে উপকূলের মানুষ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে।
স্থানীয়রা জানান, একসময় নদীর পানি পান করেই জীবনধারণ করতে হতো। বর্ষাকালে নদীর পানিতে লবণাক্ততা কম থাকলেও সেই পানি পান করার কারণে ডায়রিয়া, কলেরা, নিউমোনিয়া এবং জন্ডিসের মতো রোগে মানুষ প্রায়ই আক্রান্ত হতো। তখন খোলা জায়গায় শৌচকাজ সারা হতো, সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস ছিল না এবং পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতনতার ঘাটতি ছিল প্রকট। অসুস্থ হলে ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে পর্যাপ্ত ওষুধ বা স্বাস্থ্যকর্মী পাওয়া যেত না; গ্রাম্য ওষুধের দোকানই ছিল একমাত্র ভরসা।
এই বাস্তবতায় হেলভেটাস বাংলাদেশ-এর অর্থায়নে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডরপের ‘অ্যাকশন টু ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন্সুরিং সাসটেইনেবল সলিউশন (এক্সেস)’ প্রকল্পের মাধ্যমে কমিউনিটি পর্যায়ে বিভিন্ন সিএসও ও সিবিও—বিশেষ করে ওয়াশ বাজেট মনিটরিং ক্লাব, মা সংসদ এবং স্বাস্থ্যগ্রাম দলকে সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসব উদ্যোগের ফলে সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পিটিশন ও অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে খাস পুকুরগুলো নিরাপদ পানি ব্যবহারের উপযোগী করা, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য প্লাস্টিক ট্যাংক স্থাপন এবং পুরোনো পিএসএফ সংস্কারের কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। এর পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদের বার্ষিক বাজেট বৃদ্ধিতেও এসব সংগঠন ভূমিকা রেখেছে। উপকূলীয় উপজেলা মোরেলগঞ্জ, পাইকগাছা এবং কয়রার ১৫টি ইউনিয়নে পানি, স্যানিটেশন ও জলবায়ু খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মা সংসদের স্পিকার সুফিয়া বেগম বলেন, তারা এখন সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পানি, স্যানিটেশন এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলো সরাসরি উপস্থাপন করতে পারছেন। উপজেলা প্রশাসন বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করলেও বাজেট সীমাবদ্ধতার কারণে সব চাহিদা পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, অ্যাডভোকেসি ও পিটিশনের মাধ্যমে বেদখল হওয়া দুটি সরকারি খাসপুকুর উদ্ধার করে নিরাপদ পানির ব্যবহারের অনুমোদন পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধনের ফলে খাউলিয়া ইউনিয়নের পশুরবুনিয়া থেকে বহরবুনিয়ার ঘোশিয়াখালী পর্যন্ত প্রায় ১৪ কিলোমিটার এলাকায় নদীশাসনের কাজ শুরু হয়েছে।
ওয়াশ বাজেট মনিটরিং ক্লাবের সহসভাপতি মো. আবু সালেহ জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে বারইখালী ও বহরবুনিয়া ইউনিয়নের সংযোগকারী বারইখালী-কাটাখাল কালভার্টটি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানববন্ধন ও পিটিশনের পর উপজেলা প্রশাসন বিষয়টি আমলে নিয়ে পুনর্নির্মাণের জন্য ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়।
বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারএইডের এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখনো দুই কোটির বেশি মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। প্রতি বছর নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাবে পাঁচ বছরের কম বয়সী অন্তত ৪ হাজার ১০০ শিশুর মৃত্যু হয়।
নিরাপদ পানির তীব্র সংকটে উপকূলীয় মানুষের প্রধান ভরসা হয়ে উঠছে বৃষ্টির পানি। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় মানুষ নানা উপায়ে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে সারা বছর ব্যবহার করছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, অনিরাপদভাবে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও ব্যবহার করলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি পুরোপুরি দূর হয় না।
খুলনা জেলার কয়রা উপজেলায় গিয়ে দেখা যায়, ৫ নম্বর কয়রা ইউনিয়নের প্রায় সব জলাশয়ের পানি পানযোগ্য নয়। লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। প্রকল্পের আওতায় উত্তর মদিনাবাদ এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, একসময় ফিটকিরি দিয়ে পুকুরের পানি পান করতে হতো, ফলে ঘরে ঘরে রোগব্যাধি লেগে থাকত। পরে দূরে একটি নলকূপ বসানো হলেও দুর্গম কাদামাটির পথ পাড়ি দিতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগত।
আসিয়া খাতুন বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার পর পুরো এলাকার পানি লবণাক্ত হয়ে গেলে ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশা ও চর্মরোগে তারা ভুগেছেন। লবণাক্ততার কারণে মেয়েদের মাসিকজনিত জটিলতাও বেড়ে যায়। চিকিৎসার পেছনে মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা ব্যয় হতো। ডরপ ও হেলভেটাসের সহায়তায় বাড়ির পাশে গভীর নলকূপ স্থাপন হওয়ায় এখন পানির কষ্ট অনেকটাই কমেছে।
খুলনার আরেক উপকূলীয় উপজেলা পাইকগাছার গড়ইখালী ইউনিয়নেও একই চিত্র। পানযোগ্য পানির সংকট, দুর্বল বেড়িবাঁধ, জোয়ারের পানি প্রবেশ এবং অনিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা মিলিয়ে এখানকার জীবনও ঝুঁকিপূর্ণ। স্থানীয় গৃহিণী মাহফুজা বেগম বলেন, পুকুরের পানি ব্যবহারের কারণে আগে ডায়রিয়া ও আমাশা লেগেই থাকত, এখন তা অনেকটাই কমেছে। তবে স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি এখনো বড় সমস্যা। দুটি ইউনিয়নের মানুষের জন্য মাত্র একটি ইউনিয়ন সাব-সেন্টার থাকলেও সেখানে নেই নিবন্ধিত চিকিৎসক বা পর্যাপ্ত ওষুধ।
স্থানীয় ব্যবসায়ী খানজাহান আলী জানান, আগে কাঁচা পায়খানা ব্যবহৃত হলেও এখন স্ল্যাব পায়খানার ব্যবহার বেড়েছে। তবে ঝড়-বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে সেগুলো প্রায়ই ভেঙে যায় বা তলিয়ে যায়, ফলে ভোগান্তি থেকেই যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট পানি ও স্যানিটেশন সংকট মোকাবিলায় সিএসও ও সিবিও প্ল্যাটফর্মগুলো ইউনিয়ন পরিষদের বাজেট বৃদ্ধি ও বরাদ্দ নিশ্চিত করতে নিয়মিত অ্যাডভোকেসি চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে ধীরে হলেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে।

