দেশে সাইবার অপরাধ এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়—এটি ধীরে ধীরে ভয়ংকর সামাজিক সমস্যায় রূপ নিচ্ছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ অনলাইনে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। বাড়ছে অভিযোগ, বাড়ছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাও। অপরাধীদের কৌশল এতটাই নিখুঁত ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে যে বারবার ফাঁদে পড়ছেন সাধারণ স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) বলছে, গত পাঁচ বছরে দেশে সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে প্রায় ২ লাখ মানুষ অভিযোগ করেছেন। শুধু চলতি বছরেই ডিবির কাছে জমা পড়েছে প্রায় ৫ হাজার অভিযোগ। এসব অপরাধের মূল লক্ষ্য একটাই—টাকা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) শফিকুল ইসলাম জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সক্ষমতার মধ্যে থেকে কাজ করছে এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, সাইবার অপরাধ কমাতে হলে জনসচেতনতার বিকল্প নেই।
সিআইডির পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫৯৬ জন সাইবার অপরাধের অভিযোগ করেছেন। শুধু গত ছয় মাসেই সাইবার পুলিশ সেন্টারে যোগাযোগ করেছেন ৩ হাজার ৭৬৬ জন ভুক্তভোগী। সিআইডির মুখপাত্র বিশেষ পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন বলেন, প্রতিটি অভিযোগ অনলাইন ও ভেরিফায়েড মাধ্যমে যাচাই করে তদন্ত করা হচ্ছে।
ডিবিতে জমা পড়া অভিযোগ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজধানীসহ সারা দেশে সাইবার চক্রগুলো মূলত মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের টার্গেট করছে। তারা স্মার্টফোনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি করছে, মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে হানা দিচ্ছে এবং কখনো কখনো পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে মানুষকে মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এমনকি পুলিশের ইউনিফর্ম পরা ছবি ব্যবহার করেও প্রতারণা চালানো হচ্ছে।
গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসেই প্রায় ৫ হাজার সাইবার অপরাধের অভিযোগ এসেছে। সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধীরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সংঘবদ্ধ ও বেপরোয়া।
তাদের একটি সাধারণ কৌশল হলো—প্রথমে ভুক্তভোগীর স্মার্টফোনের কল ফরওয়ার্ডিং সেটিংস পরিবর্তন করা। এরপর মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের তথ্য বদলে ওয়ানটাইম পাসওয়ার্ড নিজেদের নম্বরে নিয়ে নেয়। এর পর মুহূর্তের মধ্যেই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নেওয়া হয়।
সম্প্রতি ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে দুর্জয় নামের এক সাইবার অপরাধী স্বীকার করেছে, সে অপরিচিত নম্বর থেকে মানুষকে ফোন করে কথোপকথনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করত এবং পরে আর্থিক প্রতারণা চালাত।
সিআইডি জানায়, গত ছয় মাসে সাইবার পুলিশ সেন্টারে যোগাযোগ করা ৩ হাজার ৭৬৬ ভুক্তভোগীর মধ্যে ১ হাজার ৮১৩ জন অনলাইনে আর্থিক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ৭৪৩ জন প্রতারিত হয়েছেন ই-কমার্সে কেনাকাটার মাধ্যমে। ৫৪৪ জন পড়েছেন ইনভেস্টমেন্ট ট্র্যাপে, ৬৪ জন লোনের ফাঁদে এবং ১১৫ জন বিভিন্ন অনলাইন সেবা নিতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন।
এ ছাড়া ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে ১৩ জন এবং এনআইডি সংক্রান্ত জালিয়াতিতে ১৭ জন আর্থিক ক্ষতির শিকার হন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অপরাধের সংখ্যা কম নয়—৮০২ জন পোস্ট, মেসেজ, ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের অভিযোগ করেছেন ২৮২ জন, ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার ১৮৭ জন, সিম ক্লোনিংয়ের শিকার ১৬৫ জন এবং অন্যান্য সাইবার অপরাধে ভুক্তভোগী হয়েছেন আরও ২৬১ জন।
সিআইডি বলছে, প্রতিটি অভিযোগের তদন্ত চলছে এবং ২ হাজার ৫৫২ জন ভুক্তভোগীকে পরামর্শ ও সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, দেশ-বিদেশ থেকে পরিচালিত এই সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়েও চিত্র উদ্বেগজনক। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ম্যান্ডিয়ান্টের গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী ৫৫ শতাংশ সাইবার হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া। অন্যদিকে বেসরকারি সংস্থা ব্লাস্টের উপপরিচালক তাপসী রাবেয়া জানান, শহরের উচ্চশিক্ষিত অনেক নারী অনলাইনে যৌন হয়রানির শিকার হলেও ভুক্তভোগীদের ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ আইনের আশ্রয় নিতে আগ্রহী নন।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক আলোচনায় সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন জানায়, গত পাঁচ বছরে দেশে প্রায় ২ লাখ মানুষ সাইবার অপরাধের অভিযোগ করেছে—যা প্রকৃত ভুক্তভোগীর মাত্র ১২ শতাংশ বলে ধারণা করা হচ্ছে। জরিপে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীদের ৮০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর এবং তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ নারী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিপফেক প্রযুক্তি সাইবার অপরাধকে আরও জটিল করে তুলছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সাইবার অপরাধের ৫৫ থেকে ৬৫ শতাংশই আর্থিক প্রতারণা—এবং প্রতি বছর অপরাধের ধরন ও সংখ্যা দুটোই বাড়ছে।
সব মিলিয়ে, প্রযুক্তির সুবিধার সঙ্গে সঙ্গে সাইবার ঝুঁকিও বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত সচেতনতা না বাড়লে এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়বে।

