একীভূত হওয়ার পথে থাকা পাঁচটি ইসলামি ব্যাংকের জন্য পথনকশা তৈরি করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ধাপে ধাপে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। রাজধানীর মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবনে একটি প্রকল্প কার্যালয় চালু করা হবে। এই কার্যালয় থেকেই ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। প্রক্রিয়া শেষ হলে নতুন ব্যাংক যাত্রা শুরু করবে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’ নামে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিকল্পনা অনুযায়ী, অক্টোবরের শুরুতে পাঁচ ব্যাংক একীভূত করে নতুন ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হতে পারে। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করবে। এরপর ধাপে ধাপে একীভূতকরণের কার্যক্রম শুরু হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলো হলো:
- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক
- সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক
- গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক
- ইউনিয়ন ব্যাংক
- এক্সিম ব্যাংক
এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এক্সিম ব্যাংক ছিল নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে। এরা সবাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ব্যাংকগুলো থেকে নানা অনিয়মের মাধ্যমে ঋণের নামে আমানতকারীদের অর্থ তুলে নেওয়া হয়, যা এখন আদায় হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বড় অংশই বিদেশে চলে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একীভূতকরণে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের স্বার্থ সবার আগে সুরক্ষিত করতে হবে। অনেক ব্যাংক একীভূত হতে চায় না। তাই কেউ আদালতে যেতে পারেন। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা মাথায় রেখে সাবধানে এগোতে হবে। যাতে আমানতকারীদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং ব্যাংক খাতে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, পাঁচ ব্যাংকের দায়, সম্পদ ও জনবল এক করা হবে। পরে তা অধিগ্রহণ করবে ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক। নতুন ব্যাংকের মূলধনের বড় অংশ দেবে সরকার। পরিচালনা পর্ষদে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি অভিজ্ঞ ব্যাংককর্মী রাখা হবে। নতুনভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ও প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা। প্রকল্প কার্যালয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদেরও পদায়ন থাকবে।
এর আগে পাঁচ ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রশাসক হবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক বা পরিচালক পদে থাকা কর্মকর্তা। তারা ব্যাংকের এমডি দায়িত্ব ও দৈনন্দিন কার্যক্রম দেখবেন। প্রশাসক নিয়োগের পর ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ বাতিল করা হবে।
প্রশাসক দল ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মিলিয়ে পাঁচ ব্যাংকের আমানত, ঋণ ও প্রযুক্তি বিভাগ একীভূত করবেন। জনবল পর্যালোচনা করে মানবসম্পদ বিভাগও এক করা হবে। এরপর তা অধিগ্রহণ করবে ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক। প্রক্রিয়া শুরু হলে ধীরে ধীরে ব্যাংকের নাম ও সাইনবোর্ড পরিবর্তন করা হবে।
পাঁচ ব্যাংকে বড় ধরনের মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। নতুন ব্যাংকের মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দেবে ২০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের আমানত বিমা তহবিল থেকে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা শেয়ার হবে। বাকি সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত আমানত গত মে মাসে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। ঋণের স্থিতি বেড়ে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা হয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭৭ শতাংশ। ব্যাংকের মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি ৯৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৯৬ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামীতে ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামীতে ৬২ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকে ৪৮ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ধার হিসেবে এক্সিম ব্যাংক পেয়েছে সর্বোচ্চ সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পেয়েছে ৭ হাজার ৫০ কোটি, এসআইবিএল ৬ হাজার ৬৭৫ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ২ হাজার ২৯৫ কোটি এবং ইউনিয়ন ব্যাংক ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বিপুল খেলাপি ঋণ উদ্ধারের জন্য ঋণগুলো সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির কাছে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। তবে আইন এখনও হয়নি। তাই ব্যাংকগুলো নিজ উদ্যোগে ঋণ উদ্ধারের চেষ্টা করছে।
পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণ বাস্তবায়নের জন্য আট সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক হয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহাম্মদ। কমিটি দেখছে, একীভূতকরণে আইনগত কোনো বাধা আছে কি না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, কেউ আদালতে যেতে পারেন। তাই সব প্রক্রিয়া সাবধানতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে। ৩৫ হাজার কোটি টাকা দিয়ে দেড় লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ সামাল দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। দোষীদের এখনো শাস্তি হয়নি। ক্ষুদ্র আমানতকারীদের স্বার্থ আগে সুরক্ষা করতে হবে। যথাযথ প্রক্রিয়া না হলে পদে পদে সমস্যা হবে।

