ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা দখলের পর এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকটির সেবা ও নিরাপত্তা মারাত্মক সংকটে পড়েছে। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে কোনো বিজ্ঞপ্তি বা পরীক্ষা ছাড়াই অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন ৮ হাজার ৩৪০ জন। এদের মধ্যে অনেকেরই শিক্ষাগত সনদ ভুয়া। ইতিমধ্যে কয়েকজন চাকরিচ্যুত হয়েছেন, বাকিদের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে।
ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এসব অবৈধ নিয়োগ ও প্রশাসনিক অনিয়মে গত সাত বছরে ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। একাধিক কর্মকর্তা জানান, এস আলম গ্রুপের আর্থিক অনিয়ম প্রকাশের পর থেকেই ব্যাংকের ভেতরে অস্থিরতা বেড়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের পটিয়া এলাকার অযোগ্য অনেককে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে চাকরি দেওয়া হয়েছে। এসব নিয়োগে শত শত কোটি টাকার অনিয়ম ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি ব্যাংকটি কর্মীদের যোগ্যতা যাচাইয়ে একটি দক্ষতা পরীক্ষা নেয়। কিন্তু চাকরিচ্যুত ও সাবেক কর্মীদের অনেকে তা বয়কট করেন। তাদের পরিবার ও সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার ছড়ান। গত শুক্রবার ভোরে ব্যাংকের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ হ্যাকের ঘটনাও ঘটে। হ্যাকাররা পেজের ছবি ও তথ্য পরিবর্তন করে হুমকিসূচক বার্তা প্রকাশ করে।
ব্যাংক সূত্র জানায়, অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ও বিদ্রোহী কর্মকর্তাদের কারণে ভল্ট ও ক্যাশ কাউন্টারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তাদের আচরণ ও অতিরিক্ত ক্ষমতার দাবি ব্যাংকের ভাড়া করা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও ঝুঁকিতে ফেলেছে। কয়েকজন কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বিদ্রোহী কিছু কর্মী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উসকানি দিচ্ছে। প্রয়োজনে তারা ক্যাশ কাউন্টার বা ভল্টে হামলারও চেষ্টা করতে পারে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এস আলম গ্রুপ ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। একই সঙ্গে নিয়োগ বাণিজ্য ও অপব্যবস্থাপনায় গত সাত বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এদিকে, এস আলম কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কারণে ব্যাংকের সেবার মানও নেমে গেছে। গ্রাহকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা এবং সেবায় অবহেলার অভিযোগ বাড়ছে। এতে গ্রাহক অসন্তোষও তীব্র হচ্ছে। চাকরিচ্যুত এক কর্মকর্তা জানান, “আমি কুড়িগ্রামের রকমারি শাখায় কর্মরত ছিলাম। কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এখনও অনেকেই ব্যাংকে রয়েছেন। তবে পরবর্তী কোনো ঘটনার দায় আমরা নেব না।”
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এস আলম শুধু ইসলামী ব্যাংক নয়, গোটা ব্যাংক খাতকেই দুর্বল করে দিয়েছে। তাদের মতে, ব্যাংকটিকে পুনরায় স্বচ্ছ ও শক্ত অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে হলে বড় ধরনের সংস্কার ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ জরুরি। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, “এস আলম একাই পুরো ব্যাংক খাতের জন্য সমস্যা তৈরি করেছে। ইসলামী ব্যাংককে ঘুরে দাঁড়াতে হলে উন্নত ব্যবস্থাপনা ও ব্যয় হ্রাস অপরিহার্য।”
ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান নজরুল ইসলাম বলেন, “বিদ্রোহী কর্মীদের আচরণ ও অনির্দিষ্ট আমানতের কারণে ভল্ট এবং ক্যাশ কাউন্টার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বিপদ বাড়বে।”
সমাজেও এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে। ব্যাংকের এক গ্রাহক আমিনুল ইসলাম ফেসবুকে লেখেন, “পটিয়ার অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্তরা চাকরি রক্ষায় আন্দোলন করছে। কিন্তু এস আলম যিনি কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন, তার বিরুদ্ধে কেন আন্দোলন নেই?” ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ফেসবুক পেজ হ্যাক ও নিরাপত্তা হুমকির বিষয়গুলো তদন্তাধীন। গ্রাহকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।